যেসব গল্প ছোটো থেকে বড়ো হয়।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।।

'প্রতিদিন ইস্কুলে পৌঁছেই অম্বুদ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে একটিই প্রার্থনা নিয়ে, সেদিন যেন প্রত্যেকটি এগিয়ে আসা সাইকেলের উপর কালো মাথা দেখা যায়। এইভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক দূরে সাইকেলের উপর সাদা মাথাটি নজরে আসা মাত্র চোখে অন্ধকার দ্যাখে সে। একবুক বিষাদ নিয়ে তাড়াতাড়ি ইস্কুল ঘরে ঢুকে নিজের চাটাই-এর ওপর বসে পড়ে।

চাটাই-এ বসে অম্বুদ ভাবতে থাকে দুর্গাপুজোর যাত্রাপালার ছবি। মাথায় লম্বা কালো চুল, পরনে শাড়ি এবং গয়না— দ্রৌপদী কিংবা সীতার করুণ বিলাপে আশ্চর্যজনকভাবে অবিকল বাজতে থাকে বড় পনশয়ের ভয়াল কণ্ঠস্বর। বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগের বানানসমূহ অম্বুদের মাথা থেকে উধাও হয়ে যেতে থাকে। হাসিমুখের ছোট পনশয় তখন তাঁর ভরাট সুরেলা স্বরে নামতা পাঠ করছেন; সকলের সঙ্গে অম্বুদও গলা মেলাচ্ছে আর ভাবছে টিফিনটা কখন হবে। বড় পনশয় চিৎকার করে বলবেন, টি-ফি-ন। তাঁর ভয়াল আওয়াজটিও তখন মিষ্টি শোনাবে। মুড়ির পুঁটলি নিয়ে সকলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে ছুটতে পুকুরপাড়ে চলে যাবে অম্বুদ ।

বর্ষাকাল না হলে পুকুরের জলটি পরিষ্কার, টলটলে। ঘাটের কাছে বেশ কিছুটা জায়গা বাদে সমস্ত পুকুরটাই শালুক পাতা আর ফুলে ভরতি হয়ে থাকে। রাস্তার দিকের পাড়টি পায়ে পায়ে ন্যাড়া হয়ে গেলেও বাকি তিন দিকের পাড়ে বুনো সজীব ঘাস লকলক করে হাওয়ায় দোলে।

অম্বুদ পুকুরে নেমেই মুড়ির পুটলি জলে ডুবোবে। শুকনো মুড়িতে জল ঢুকলেই হাওয়া বেরিয়ে আসে আর জলে বুজকুড়ি কাটে। সঙ্গে সঙ্গে নাকে ঢোকে ভেজা মুড়ির গন্ধ। তাতে খিদেটা আরও চনমনে হয়ে ওঠে।

তারপর ঘাটের পাড়ে তেঁতুলগাছের ছায়ায় পুঁটলি খুলে মুড়ি খাবে অম্বুদ। কী তার স্বাদ! মুড়ি যতই ফুরিয়ে আসে, জল শুকিয়ে আধশুকনো হয়, ততই বাড়ে তার স্বাদ।

খাওয়া শেষ হলে পুকুরে নেমে ন্যাকড়া ধুয়ে আঁজলা ভরে জল খাবে অম্বুদ। খুব মিষ্টি সেই জল। এরপর পুকুর থেকে উঠে এসে একটুখানি ছোটাছুটি, খেলা। তারপর মেজো পনশয়ের কাছে বসতে হবে।

মেজো পনশয়ের বড় বড় দাঁত। সেগুলি তাঁর অধরের বাইরেই অধিষ্ঠান করে। চুলগুলিও খাড়া-খাড়া ৷ তবু তাকে ভয় পায় না অম্বুদ। তিনি শুধু বলবেন, কার কার পড়া হয়নি হাত তোল। অম্বুদ মহানন্দে হাত তোলে। মেজো পনশয় অম্বুদের পেটে একটামাত্র চিমটি কাটেন।

তবে অনেক হাত উঠলে তিনি রেগে যান। এতজনকে চিমটি কাটতে তাঁর কষ্ট হয় নিশ্চয়।

শাস্তির পাট চুকলে কেবলই মজা। মেজো পনশয় পকেট থেকে দেশলাই বাক্স বের করে তার কাঠিগুলি সব নিজের কোলের ওপর রাখবেন। তারপর একটি করে কাঠি আধখানা ব্লেড দিয়ে চিরে একটিকে দুটি করবেন, দুটিকে চারটি। তখন গোলমাল না করে মন দিয়ে তাঁর নিপুণ কাজটিকে দেখে যেতে হবে।

দুটিকে চারটি করতে গিয়ে ক্বচিৎ কখনও তিনি গণ্ডগোল করে ফেলবেন। তেমন দুর্ঘটনার সময় সাগ্রহী দর্শকদের মধ্যে কেউ হেসে ফেললেও তিনি রেগে যাবেন না; করুণ চোখে সেই হাসিটির দিকে তাকিয়েই আবার মগ্ন হয়ে যাবেন নিজের কাজে।

এই মেজো পনশয় একদিন এলেন না ইস্কুলে। টিফিনের পর ইস্কুল বসতেই বড় পনশয় প্রথম শ্রেণির পড়ুয়াদের নিয়ে বসে পড়লেন মেজোর চেয়ারে। আর পড়বি তো পড় অম্বুদকে নিয়েই পড়লেন। বানান ধরতে লাগলেন ।

দ্বিতীয় ভাগের যুক্তাক্ষর শব্দ। প্রথম ভাগটা কোনওরকমে আবছা আবছা শেষ করেছে সে। দ্বিতীয় ভাগের জটিল শব্দের বানান মাথার মধ্যে কেবলই জট পাকিয়ে যায়। তার উপরে বড়র ক্রমশ উচ্চকিত কণ্ঠস্বর তাকে একেবারে বেহাল করে দেয়। সমস্ত জিজ্ঞাসার জবাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অম্বুদ।

অবশেষে বড় পনশয়ের চিৎকৃত আদেশ, এক ঠ্যাঙে দাঁড়া।

দাঁড়াল অম্বুদ ।

কান ধর।

নিজের দুই কান দুই হাত দিয়ে ধরে অম্বুদ। তার পরেই বড় পনশয় তাঁর রুলবাড়ি নামক হাতিয়ারটি চালাতে লাগলেন। অম্বুদের পায়ে। বাড়ি খেয়ে মাঝে মাঝে এক ঠ্যাং থেকে দুই ঠ্যাং হয়ে যায় সে। কিন্তু সন্ত্রাস-সচকিত বাঁ-পা-টি মাটি ছুঁতে না ছুঁতেই আবার উঠে পড়ে ডান পায়ের উপরে।

অবশেষে যখন রেহাই পেল অম্বুদ, তখন তার রক্তরাগলাঞ্ছিত পা ফুলে ঢোল। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করার ক্ষমতা বিধায়ে বড় পনশয়ের কদর ছিল অভিভাবকমহলে। কাজেই সেই ঢোল পা নিয়ে অশ্রুকপোলিত বদনে বাড়ি ফিরে যে সাদর অভ্যর্থনা মিলবে না তা জানাই ছিল তার। তবু মা অন্তত সন্ধেবেলায় গরম তেল নিয়ে তার পা মালিশ করতে করতে অস্ফুট মন্তব্য করেছিলেন, চণ্ডাল।'


অম্বুদের পাঠশালা
.....................................
যেসব গল্প ছোটো থেকে বড়ো হয়
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ২৩০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।