যেসব গল্প ছোটো থেকে বড়ো হয়।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।।

সরু খাল। দশ-বারো হাতের বেশি চওড়া নয় কোথাও। জলও কদাচিৎ হাঁটুর উপর ওঠে। পুটুর পরনে একটা গামছা। শাড়িটা বুক ও গলায় জড়িয়ে রেখেছে। একটি মাত্র শাড়ি, ভেজানো চলে না। তাছাড়া রাতের বেলায় লজ্জা কিসের, কে আর দেখছে। গামছা পরে হাঁটতেও সুবিধে, জেলেদের তাড়া খেলে ছুটতেও। খালের পাড়ে ছোট বড় গাছের সারি। মাঝে মাঝে হাওয়া লেগে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে জলের উপর। এই ঠাণ্ডা হাওয়াতেও পুটুর কপালে ঘাম। সে হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। তারপর বুকের উপর জড়িয়ে রাখা শাড়ির কোঁচড়ে হাত দিল। আজ অনেক মাছ পাওয়া গেছে। কাল হয়ত বা আর আসতেও হবে না। ছোট ভাইটার পায়ে ঘা। ক্রমশ যেন পচে যাচ্ছে পাটা। কাল ভাইকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। তাতে আবার যদি তাকে কাল মাছ চুরি করতে আসতে হয় তা-ও না হয় আসবে।

এভাবেই পুটু বেঁচে থাকে। জ্ঞান হয়ে ইস্তক সে জানে তাকে বেঁচে থাকতে হবে, আর বাঁচিয়ে রাখতে হবে ভাইটাকে। বেঁচে থাকার কৃৎকৌশল খুঁজতে খুঁজতে এটাই পেয়ে গেছে পুটু। এই খালে জেলেরা আড় জাল পাতে। আর সেই জাল থেকে মাছ চুরি করে সে গভীর রাতে। জেলেগুলো বড়ো হিংস্র। কেননা মাছ-ই ওদের বাঁচিয়ে রাখে। সেই মাছে কেউ হাত দিলে ওদের মাথায় খুন চড়ে যায়। পুটুর তাই বড়ো ভয়। ধরা পড়ে গেলে ওরা নির্ঘাত মেরে ফেলবে। জেলেরা জানে পুটু মাছ চুরি করে। তাকে ধরার জন্যে তারা তক্কে তক্কে থাকে। কিন্তু পুটু বড়ো পিছল মেয়ে। বেঁচে থাকার কায়দা সে রপ্ত করে ফেলেছে। তাই তাকে কায়দা করে ওঠা দায়। তবুও পুটুর ভয় করে। তার নৈঃশব্দকে ভয়, আবার শব্দকেও ভয়।

আর মাত্র একটা জাল দেখতে বাকি। শেষ জালটা অনেকটা দক্ষিণে পাতা। তাড়াতাড়ি যাবে বলে খালের পাড়ে উঠে এগিয়ে যেতে মনস্থ করল পুটু। ওইটা দেখা হয়ে গেলেই ঘরে চলে যাবে সে। আঁধার রাতে একাকী চুপি চুপি পায়ে ঘরে যাবে। ভাইকে আর জাগাবে না। ভাই বুঝতেও পারবে না—উঃ! —হঠাৎ নিজের অজান্তে পুটুর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে গেল। কিসে যেন কামড়েছে পায়ে। সে তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে নিজের মুখ চাপা দিল। জেলেরা যদি শুনতে পেয়ে যায়, তাকে মেরে ফেলবে। পুটু খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়ায়। না, কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। কেবল নিজের ভেতরে বেঁচে থাকার আওয়াজ আর জলের টুলটুল-টুলটুল। আবার সে সন্তর্পণে পা বাড়ায়। পা-টা জ্বালা করছে। তা করুক। ততক্ষণে শেষ জালটার সামনে এসে পড়েছে পুটু। উল্টোদিকের পাড়ে জেলেদের কুমোতে লণ্ঠন জ্বলছে। সবাই ঘুমিয়ে আছে। ধীরে ধীরে জলে নামে পুটু। জালের ভেতরে জল হাতড়ায়। খলবল করে মাছ। প্রায় কেজি ওজনের, হাতের আন্দাজে বোঝে পুটু। খালের জলে এত বড় মাছ কমই থাকে। পুকুব-ভাসা রুই-মিরগেল হতে পারে। তার তিন-চার দিনের চাল কেনা হয়ে যাবে। চাই কি, নিজেদের জন্যে একটা রাঁধতেও পারবে। আহ, বেঁচে থাকার কতো সুখ ! শাড়ির কোঁচড়ে ভরে তাতে ভালো করে গিট দেয় পুটু। আর তার ভয় করছে না—শব্দ বা নৈঃশব্দ, কোনো কিছুতেই আর ভয় নেই তার। সে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়াল না। দাঁড়াতে পারল না বোধ হয়। শরীরটা কেমন অবশ বোধ হচ্ছে। মাথায় ঝিম ধরছে, গা-টা জ্বালা-জ্বালা করছে। এতক্ষণে পুটুর মনে পড়ল, কিছুক্ষণ আগে কিসে যেন তাকে কামড়েছে। ভয়ানক বিরক্ত হল সে। কী বিচ্ছিরি ব্যাপার! আজ তার কোঁচড়ে কত মাছ। তার তিন দিনের বেঁচে থাকা— পেটের খোরাক—আয়ু। আজ তো কিছু তাকে না কামড়ালেই পারত! কাল ভাইকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সে আর একবার উঠে দাঁড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে জেলেদের জালের উপরেই বসে পড়ল। জালের ভেতর আরও অনেক মাছ, সেগুলো পুটুকে ধাক্কা মারতে শুরু করল। পুটুর ইচ্ছে হচ্ছিল সব কটাকে আঁচলে বেঁধে নিতে। কিন্তু হাত উঠছে না। এ কেমন ফ্যাসাদ। আজকে বলে তার একটা ভালো দিন। এ দিনটায় এমনটা না হলেই চলছিল না? জিজ্ঞাসাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতেই তার শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট শুরু হল। 

-এমন সোনার দিনে আমায় সাপে কাটলা গা—পুটু অবশ মনে ভেংচি কাটে,– আমার বেঁচে থাকায় তোর এমন ব্যাগড়া দেওয়া কিসের শুনি... তোর কোন বাড়া ভাতে আমি ছাই দিয়েছি... রাগে, অভিমানে পুটুর দম বন্ধ হয়ে এল। বড়ো দুঃখে সে আঁচলের গিঁট খুলে দিতে চাইল, আমি না বাঁচি তো ওরা বাঁচুক... কিন্তু পারল না, আঁচলের গিঁটে হাত দিয়েই সে জলে শরীর আর ডাঙায় মাথা রেখে চোখ বুজল।

তখন খাল পাড়ের বিশাল অর্জুন গাছের মাথায় বসে এক বৃদ্ধ পেঁচা প্রাজ্ঞ চোখে পুটুকে নিরীক্ষণ করে ডেকে উঠল, হ্যাচা-হাচ্চা—হ্যাচা - হাচ্চা... পুটু এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেল, – বেঁচে থাক বাছা–বেঁচে থাক বাছা...


বেঁচে থাকা
.....................
যেসব গল্প ছোটো থেকে বড়ো হয়
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ২৩০ টাকা

#সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।