সেকালের সমাজচিত্র।। দীনেন্দ্রকুমার রায়।।

‘পিউনিটিভ’ পুলিশ একালের পাঠক সমাজে 'পিটুনি পুলিশ' নামে অভিহিত হইলেও আমি সেকালের গ্রাম্য ইংরেজি স্কুলের যে মাস্টারটিকে ‘পিটুনি মাস্টার' নামে পরিচিত করিতেছি—তিনি অকারণে বা সামান্য কারণে স্কুলের ছেলেদের এরূপ ভীষণ প্রহার করিতেন যে, আমরা তাঁহাকে পুলিশের মতোই ভয় করিতাম। একালের মাস্টারদের সাধ্য কি সব্যসাচী হইয়া তাঁহারা সেভাবে বেত্র চালনা করেন। ছেলেদের পিঠে 'কচার ডাল' নামক আয়ুধের শক্তি পরীক্ষা করিতে করিতে যখন তাঁহার দক্ষিণ হস্ত অবসন্ন হইত, তখন তিনি বাম হস্তে কেঁচে গণ্ডূষ করিতেন—যেহেতু তাঁহার উভয় হস্তেরই সঞ্চালন ও উত্থান-পতনের দক্ষতা সমান ছিল। সেকালের পাঠশালার খঞ্জ গুরুমশায় সীতানাথ অধিকারীর বেতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাইয়া আমরা ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বেতের আস্বাদন ভুলিয়াই গিয়াছিলাম, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে স্কুলে সহসা যে নূতন হেডমাস্টারটির আবির্ভাব হইল— দেখা গেল, বেত্র-প্রয়োগে তিনি পাঠশালায় গুরুমশায় ‘সীতে খোঁড়ার'ও গুরু হইবার যোগ্য।

আমার প্রতিবেশী ও সহপাঠী মুনুর (মনমোহন অধিকারী) অনেক মনোহর গুণের কথাই পূর্বে লিখিয়াছি। তাহাদের বাসগ্রামে একঘর জমিদার ছিলেন, তাঁহাদেরই একটি জামাই যগু ঘোষ (যোগেশ কি যোগীন—এতকাল পরে তাহা স্মরণ নাই) বি. এ. পাশ করিয়া চাকরির উমেদারি করিতে করিতে স্বর্গীয় ভূদেব মুখোপাধ্যায়- পরিচালিত 'এডুকেশন গেজেটে' কর্মখালির একটা বিজ্ঞাপন দেখিয়া জানিতে পারেন—আমাদের গ্রামের ইংরেজি স্কুলের হেডমাস্টারের চাকরি খালি আছে। তিনি এই সুযোগ উপেক্ষা করিতে না পারিয়া শ্বশুরবাড়ি আসিলেন এবং স্কুলের সম্পাদক মহাশয়ের নিকট ঐ চাকরির জন্য দরখাস্ত দাখিল করিলেন। সেকালে একালের মতো হাটে-মাঠে বি-এ, এম-এ দেখিতে পাওয়া যাইত না; বরং কেহ বি-এ, এম-এ পাশ করিয়া পল্লীগ্রামে আসিলে, তাঁহার কাঁধে আর দুইখানি হাত গজাইয়াছে কি না, তাহা দেখিবার জন্য ভদ্র পল্লীবাসীরা সোৎসুক চিত্তে বহু দূর হইতে তাহার অনুসরণ করিতেন। আমার স্মরণ আছে, কৃষ্ণনগর কলেজের বিজ্ঞানাধ্যাপক আমার পিতৃবন্ধু শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয় সরকারের বৃত্তি লইয়া বিলাতের কৃষি কলেজ হইতে পাশ করিয়া যখন বাড়ি আসেন —বোধহয় ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দেরও পূর্বে—তখন বিলাত হইতে তিনি 'চাষা' হইয়া আসিয়াছেন শুনিয়া 'বিলেত-ফেরত চাষা' কী রকম দেখিবার জন্য বিস্তর লোক তাঁহাদের অট্টালিকার আঙ্গিনা পূর্ণ করিয়াছিল কিন্তু তাহারা ধুতি চাদর পরা একটি নিরীহ ভদ্রলোক দেখিয়া অত্যন্ত হতাশ হইয়াছিল। গ্রামস্থ কাশ্যপ পাড়ার মাতব্বর চাষা সাধু মণ্ডল ক্ষুণ্ণস্বরে বলিল- 'ওঃ! কুতায় বাবুর বিলিতি নাঙ্গোল, আর কুতায় বা মাথার বিলিতি মাথাল?’—তাঁহাদের চাকর মণিরাম তাহাকে খুশি করিবার জন্য তাঁহার একটা ‘হ্যাট’ দেখাইয়া বলিয়াছিল— 'এই তো মাথাল!' সাধু বলিয়াছিল, ‘ঐ সায়েবী মাথাল তো এ দেশেই পাওয়া যায় ও মাথায় দিয়ে চাষ করতে বাবু বিলেত গেলেন কেন? এ দেশে পেতেন না?'—কিন্তু তাঁহার সেই শিক্ষা নিষ্ফল হইয়াছিল; ফৌজদারি মামলার রায় লিখিতে লিখিতে তাঁহার ‘তাঁতিকুল বৈষ্ণবকুল’ উভয়ই নষ্ট হইয়াছিল। স্বর্গীয় এ. কে. রায় প্রভৃতি  অনেক বিলেত-ফেরত 'চাষার’ পরিণামই ঐরূপ হইয়াছিল ; কেবল ব্যোমকেশ চক্রবর্তী মহাশয়ের ভাগ্যে সোনা ফলিয়াছিল—সঙ্গে সঙ্গে তিনি ব্যারিস্টারি পাশ করিয়া দেশে ফিরিয়াছিলেন বলিয়া।

সেকালে বি-এ, এম-এ এতই দুর্লভ ছিল যে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হুদ্দা উত্তরে নেপাল হইতে দক্ষিণে সিংহল দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকিলেও সংবৎসরে তিন শতাধিক পরীক্ষার্থীকে বি-এ পাশ করিতে দেখিতাম না! সুতরাং সেই কালে যগু ঘোষকে আমাদের গ্রামের স্কুলে পঞ্চাশ টাকা বেতনে হেডমাস্টার নিযুক্ত হইতে বিশেষ কোনো যোগাড়যন্ত্র করিতে হয় নাই।...' 

পিটুনি মাস্টার 

দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত 
সেকালের সমাজচিত্র

সংকলন, সম্পাদনা : শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা 

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।