কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

সেই যে চলে আসা। তারপর দেখা হয়েছিল একবার। হেসে হেসে কথা বলেছিল। কিন্তু কোনও অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই, যেন সবই বিধির বিধান। এমন হবার কথাই ছিল। মনে আছে ঘটনাটা। রাফায়েল দল নিয়ে যাচ্ছিল তাহেরপুরে। বড়োদিনের পরে। পালা গাইবে সে। ট্রেন থেকে নেমে সকলে একটু হাত-পা ছড়িয়ে ওভারব্রিজে উঠতে যাবে, এমন সময় ব্রিজের নীচ থেকে কে যেন ডাকল, নতুন গোঁসাই, কেমন আছো ?

চমকে তাকাল রাফায়েল। একটু থমকে গেল। সে দলের লোকদের বলল, তোমরা এগোও, আমি আসছি।

দেখল, তুলসি আগের মতোই আছে। মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে। শরীর একটু ভারি হয়েছে। সে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, তুমি!

হাসল তুলসি। বলল, এই তাহেরপুরে এসেছিলাম। আসর ছিল দু-দিন। ফিরে যাচ্ছি। তোমার খবর কী?

—আছে। চলছে।

—সংসারী হয়েছ?

—না।

অবাক চোখে চাইল তুলসি। বলল, কেন?

রাফায়েলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, শরীরটা তো একজনের কাছে বন্ধক দিয়েছিলাম, ছাড়াতে পারিনি। আর একজনকে দেওয়া শরীর কি অন্যকে দেওয়া যায়?

কথাটা বলেই সে অবাক হয়ে গেল, এমন কথা সে বলতে পারল কীভাবে? ও তো দর্শনের কথা। তুলসি কিন্তু ভাবল না কিছু। সে হাসল। বলল, স্নান করলেই শরীর শুদ্ধ হয়ে যায়।

কথাটা শুনে থমকে যায় রাফায়েল। ভাবে বাইবেলেও তো এমন কথা লেখা আছে। যিশু যখন শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিচ্ছিলেন, তখন প্রধান শিষ্য পিতর বা পিটার তাকে বললেন যে, যিশু যেন শুধু পা নয়, তার মাথা ও হাতও যেন ধুইয়ে দেন। যিশু তার উত্তরে বললেন, যার স্নান করা হয়ে গিয়েছে, তার পা ছাড়া আর কিছুই ধোয়ার দরকার নেই। সে তো সর্বাঙ্গে পরিষ্কার হয়েছে। অর্থাৎ সে শুদ্ধ। সে ভাবল, বৈষ্ণবধর্মের এমন তত্ত্ব কি করে বাইবেলের তত্ত্বের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে?

—কী ভাবছ গোঁসাই?

—না, কিছু না।

—কোথায় যাচ্ছ? তোমার বুঝি আসর আছে? সুরেন গোঁসাই বলছিল, এখন তুমি বেশ নাম করেছ। তোমাদের ধর্মের নাম করা কীর্তনীয়া। বেশ ভাল। তবে একটা কথা বলি, শুধু গাইয়ে হয়ে থেকো না। ধর্মটার ভিতরে ঢুকে হৃদয়ে ঢুকিয়ে নিও। আমি তো পারলাম না, শুধু খোলস পরেই দিনপাত করলাম। ভিতরটা নেড়ে-ঘেঁটে দেখলাম না। দেহটা মনের সঙ্গে মিলিয়ে মন্দির করলাম না। আর দশটা গাইয়ের মতো শুধু গান গাইলাম আর ভোগ করলাম। তুমি তা কোরো না গোঁসাই। তোমাকে আজও আমি ভালবাসি। সত্যিই তোমাকে মন দিয়েছিলাম। তুমি তো খাঁচার পাখি নও, অনন্ত আকাশে তোমার জনে ওঁত পেতে রয়েছে। আমার সাধ্য কী তোমাকে আটকে রাখার।

স্টেশনের মাইকে ঘোষণা হলো, কৃষ্ণনগর যাওয়ার শিয়ালদার গাড়ি আসছে। একজন এসে তুলসিকে ডাকে। বলে, চলো, গাড়ি আসছে।

— আসি গোঁসাই। তুলসি তার দিকে সজল চোখে চেয়ে বলল, সংসার করতে মন না চায় কোরো না, তবে তুলসি দাসী তোমার জন্য আছে। মন চাইলেই চলে এসো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুলসি। আর কোনও কথা না বলে দলের লোকদের সঙ্গে এগিয়ে গেল। সেদিকে চেয়ে রইল রাফায়েল। ভিতরটা কেমন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ট্রেন ঢুকছে। সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভাঙল। দলের লোকেরা ওর পরে অপেক্ষা করছে।

কীর্তনীয়া
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।