নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।।
খালারি স্টেশনের পাশ দিয়ে বেঁকে যাওয়া রাস্তা ছয় কিলোমিটার অতিক্রান্ত হবে যখন, গঞ্জে ঢোকার মিনিট পাঁচেক আগে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে একটা টিলা উঠে যেতে দেখা যাবে। তার অন্যদিকের গা বেয়ে জঙ্গল ভরতি খাদ। এই জায়গায় ঢেউ খেলানো পথ বাঁ-দিকে একটা বাঁক নিয়েছে। অঞ্চলটাকে মন দিয়ে লক্ষ করা দরকার। লোকে বলে, এখানে পাহাড়ি ভূতের দল বাসা বেঁধে আছে অনেকদিন হয়ে গেল। সেই যেদিন থেকে রেভারেন্ড ওয়েসলি গঞ্জে প্রথম মিশনারি স্কুল তৈরি করেছিলেন, তা সে আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগের কথা, অথবা, তারও আগে হতে পারে, যেহেতু মানুষ ভুলে গেছে। রাত্রিবেলা সেসব ভূতের ফুটিফাটা আত্মার গহ্বর থেকে বেরোনো সাঁই সাঁই গাঢ় নিশ্বাসকে আশপাশের মুন্ডা ওরাওঁ গ্রামগুলোর অভুক্ত কাঠকয়লা চোরের হাঁপানি হিসেবে ভুল করার কারণ দেখেনি কেউ। একপাশে আধভাঙা বেথেল মিশন চার্চ ভূতের গল্পে সারজল জুগিয়েছে। অন্ধকারে ফিসফিসানি, চাপাগলায় অট্টহাসি, অথবা, অকস্মাৎ ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ সবাই পেত সেখানে। দিনের বেলা জায়গাটা সাফসুতরো থাকত। আদিবাসী রমণীরা খোলা জায়গায় বসে রোদ পোয়াত। আচার শুকোতে দেওয়া হত পাথরের গায়ে। কিছুদূর দিয়ে বয়ে গেছে একটা পাহাড়ি ঝোরা। তার জলে নিঃসংকোচে স্নান করার সময়ে পথচলতি টুরিস্টের হাঁ চোখকে নির্লিপ্ত অবহেলায় ঝরিয়ে দেওয়া যায়। শিশুরা ধুলো, পাথর অথবা বল নিয়ে অক্লেশে লাফালাফি করে, লুকোচুরি খেলে চার্চের ভেতর। মায়েরা অলস চোখে তাকায়। মাঝে মাঝে গলা উঁচু করে ধমক দিলেও তার ভেতর নিষেধ ছিল না। পাথুরে চ্যাটালো চত্বর, তাকে ঘিরে শাল, সেগুন, পিয়ালের পুঞ্জ আর অবিরল সূর্যোদয় নিশ্চিন্তির ঊষ্ণতা দেয়। অনতিদূরে গঞ্জের প্রান্তভাগ তাকে স্তিমিত করতে পারবে না।
এখানে দুপুর বেলা আসে কিশোরীর দল। তারা বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে থাকা বান্ধবীরা, যারা মিলনস্থল হিসেবে জায়গাটাকে বেছে নিয়েছে। ছোটো থেকে তারা এই স্থানকে 'জোহার হালে' বলে জানে। শব্দটা মুন্ডারি, যদিও এই মুহূর্তে এখানে, শুধু এই মুহূর্তে কেন, যেদিন থেকে কোল বিদ্রোহে অংশ নেওয়া মানকি মুন্ডাদের নির্মমভাবে দমন করেছিল ব্রিটিশ সরকার, সেদিন থেকে সমগ্র ছোটোনাগপুর জুড়ে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য কমছে। তবু সংস্কৃতি মাথা নোয়ায় না। ফলত, তাকে নিরুপায় হয়ে মেনে নিয়েছে রাজতন্ত্র, তার পরের রাতু মহারাজরা, তার পরের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা, তারও পরের বাঙালি-হিন্দি পাঁচমিশেলি উপনিবেশ ও তারও পরের, পরের ও পরের—শব্দের মৃত্যু নেই। অন্য যে নামে ডাকো না কেন, নাছোড় স্মৃতি তবু 'জোহার হালে' নামেই জায়গাটাকে চিনবে। 'জোহার হালে' মানে, দু-জন মানুষ মুখোমুখি দেখা হলে যেভাবে একে অপরকে অভ্যর্থনা জানায়। যেমন, ইংরেজিতে 'হ্যালো'। কিশোরীরা এখানে আসে নিজেদের রহস্যময় কাহিনিগুলোর ভাগবাঁটোয়ারা করতে। কোন তরুণকে তাদের ভালো লেগেছিল অথবা নিভৃত চুমুর বিনিময়ে কে দিল হৃদয়প্রস্তাব, সেই সমস্তকে শোনে পাথুরে শ্যাওলা, ঝরনা, শালবন।
.
.
.
নৈশ অপেরা
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা
সুপ্রকাশ
আসছে...
Comments
Post a Comment