নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত অলোক সান্যালের উপন্যাস 'নষ্ট চাঁদের আলো' পড়ে লিখেছেন তন্বিশ্রী মাঝি। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
..........................
পড়া শেষ হলো অলোক সান্যাল রচিত ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস "নষ্ট চাঁদের আলো"। তবে এটিকে শুধুই ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস বললে ভুল হবে, এটি একটি দুর্ধর্ষ থ্রিলারও বটে। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা এই উপন্যাসে একদিকে যেমন উঠে এসেছে নিজেদের সভ্য বলে দাবি করা ইংরেজদের কলঙ্কিত অধ্যায় , অপরদিকে সমান্তরাল ভাবে গল্পে এসেছে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সেই অতীতের খোঁজে ফিরে চলা এক দুর্দমনীয় নারী এমা মিলারের গল্প।
উপন্যাসটি দুটি ভিন্ন সময়কে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে - একদিকে কুইন অ্যানের শাসনকালে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে জলদস্যুদের, বিশেষ করে আটলান্টিকের ত্রাস ব্ল্যাকবিয়ার্ডের উত্থান, এবং শেষে ওক্রেকোক খাঁড়ির যুদ্ধে রয়েল নেভির হাতে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের মৃত্যু এবং তাঁর লুকানো ঐশ্বর্য নিয়ে গড়ে ওঠা নানান কিংবদন্তি , অপরদিকে বর্তমান সময়ে লন্ডনে এমা মিলারের সেই ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ফ্ল্যাগশিপ "কুইন অ্যানিস রিভেঞ্জ" খুঁজে পাওয়ার দুঃসাহসিক অভিযান এবং তাকে কেন্দ্র করে দুর্যোগের ঘনঘটা। ঘটনাপ্রবাহের ক্ষেত্রে লেখনীর ভাষা বেশ নজর কাড়ে। সময় যত এগিয়েছে ততোই রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠেছে উপন্যাসের ঘটনাক্রম।
উপন্যাসের শুরুতেই ধরা পড়ে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আমদানি করে ইংল্যান্ডের নানা শহরে বেচা ক্রীতদাসদের উপর ইংরেজদের অকথ্য অত্যাচারের কাহিনী। সমুদ্রের অসীম জলরাশির মধ্যে একটুকরো জাহাজের ডেকে সেই অত্যাচার নষ্ট করে দেয় চাঁদের আলোর মনোমুগ্ধকর শোভা। শুধু আফ্রিকার ক্রীতদাসরাই নন, ইংরেজদের দ্বারা সমান ভাবে শোষিত ও অত্যাচারিত হন নেটিভ আমেরিকানরাও। সেই কাহিনী পাঠকের অন্তঃস্থলে রক্তক্ষরণ করতে বাধ্য করে। কিন্তু সেই একই সময়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে শয়তান বলে দাবি করা জলদস্যু যেনো পাঠকের অনেক কাছের একজন হয়ে উঠেছে, যাঁর কাছে জাতি - বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই মানুষ। লুঠ হওয়া জাহাজের ক্রীতদাস তাই নিজ ক্ষমতাবলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরই একজন হয়ে ওঠে । এমা মিলারের দুঃসাহসিক অভিযানের শেষে যে বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে তা হলো মানুষের লোভের পরিণাম। এছাড়া কাহিনীর মোড়কে জন্মান্তরের বিষয়টিও পাঠককে মুগ্ধ করে।
উপন্যাসটি পড়ার সময় একটি সিরিজের কথা বিশেষ ভাবে মাথায় আছে, সেটি হলো - "পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান"। বিশেষ করে জাহাজের বর্ণনায়, জলদস্যুদের বর্ণনায় পাঠকের চোখের সামনে যেনো জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রতিটি চরিত্র। এছাড়াও আরও যে বিষয়টি উপন্যাসটি পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে তা হলো ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস বিশেষ করে তৎকালীন ইংল্যান্ডের ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। বিশেষ করে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, কুইন অ্যান এবং পরবর্তীকালে প্রথম জর্জ এর শাসনকালে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, পার্লামেন্টে হুইগ এবং টোরি এই দুই রাজনৈতিক দলের ভূমিকা, বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের ভূমিকা , রাজকর্মচারীদের সামাজিক অবস্থান - এই সবকিছুই উঠে এসেছে উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়। তাই এ সম্পর্কে সাধারণভাবে কিছু ধারণা না থাকলে উপন্যাসটি পড়তে একটু অসুবিধা হতে পারে বলে আমার অভিমত। তাই আমার মতো সাধারণ পাঠকের জন্য লেখক যদি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফুটনোট ব্যবহার করতেন তবে বেশ উপকার হতো বলেই মনে হয়।
সামগ্রিকভাবে উপন্যাসটি বেশ সুখপাঠ্যই মনে হয়েছে আমার কাছে। দুটি ভিন্ন সময়কে যেভাবে লেখক নিজ দক্ষতায় মিলিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। টাইম মেশিনে চেপে অষ্টাদশ শতকের ইংল্যান্ডে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসার জন্য অবশ্যই হাতে তুলে নিতে পারেন অলোক সান্যালের এই উপন্যাস "নষ্ট চাঁদের আলো"।
উপন্যাস - নষ্ট চাঁদের আলো
লেখক - অলোক সান্যাল
প্রকাশনা - সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য - ₹ ৫৯০/-
Comments
Post a Comment