নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'নৈশ অপেরা' পড়ে মতামত জানিয়েছেন অর্ণব কর। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
........................................................
পাঠ প্রতিক্রিয়া :
"নৈশ অপেরা"
লেখক : শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রকাশক : সুপ্রকাশ প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ : জুন, ২০২৫
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৪১০
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা
গতকাল বইটি পড়া শেষ করেছি। এখনও তার রেশ কাটেনি। উপন্যাস শেষ, রহস্য উন্মোচিত কিন্তু তবু যেন আমি দুপাশে জঙ্গলঘেরা ডেগাডেগি নদীর ধারে নির্জনে একাকী বসে আছি। উপন্যাসের স্থানীয় চরিত্রগুলো আমার চারপাশ দিয়ে ছায়া আবছায়ার মতন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও নিঃশব্দে পাশে এসে বসছে। কখনও পিছনে এসে দাঁড়াচ্ছে। কখনও কারো গলার আওয়াজ শুনে সেরকমই কোনো ছায়ার পিছু পিছু আমি হয়তো জঙ্গলে ঘেরা উঁচু নিচু পথ দিয়ে পাড়ি দিয়েছি তিতিরকান্না মাঠের দিকে।
আমি বাকিদের মতন উদ্ধৃতি তুলে তুলে গতে বাঁধা নিয়মে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে পারিনা। আমার নিজের বক্তব্যই যতটা সংক্ষেপে হয় লিখে বোঝাতে চেষ্টা করি। স্পয়লার যাতে না দিয়ে ফেলি সেই দিকেও সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়।
লেখকের লেখা আরেকটি রহস্য উপন্যাস দার্জিলিং এর পটভূমিকায় "শেষ মৃত পাখি" পড়ে শিহরিত হয়েছিলাম। থ্রিলার পড়ে যদি thrilled ই না হলাম তো সেই থ্রিলারের সার্থকতা কোথায়? কিন্তু না। শাক্যজিৎ বাবু সেক্ষেত্রে কোনো অভিযোগের জায়গা রাখেননি ওই উপন্যাসে। এমন অদ্ভুতভাবে রহস্যকাহিনী টি উপস্থাপিত হয়েছিল যে সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। তবে এই উপন্যাসটি, মানে "নৈশ অপেরা" কি সেই থ্রিল ধরে রাখতে ব্যর্থ হোলো? সেকথায় পরে আসছি। আমি আবারও ফিরে যাচ্ছি ঝাড়খণ্ডের ডেগাডেগি নদীর তীরে সেই ভেঙে পড়া টাউনটিতে। ভাঙাচোরা বাড়ি। ভেঙে পড়া কিছু মানুষ। ভগ্নপ্রায় চার্চ। আর একটি অর্ধ ভগ্ন কটেজ। প্রকৃতির যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, যেভাবে দিয়েছেন, পড়তে পড়তে প্রতি মুহূর্তে ওই জায়গার সাথে একাত্ম হয়ে যেতে হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা পড়ে প্রকৃতির সাথে বারংবার একাত্ম হয়েছি পূর্বে। বুদ্ধদেব গুহর লেখাতেও এই ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চলের প্রাকৃতিক বর্ণনা উঠে এসেছে । সেই বর্ণনায় একাত্ম হয়েছে প্রেম ও প্রকৃতি। কিন্তু এই উপন্যাসের প্রাকৃতিক বর্ণনার পরতে পরতে রয়েছে শিহরণ। হরর ছায়াছবিতে পরিচালক যেমন দর্শকদের ভয় দেখানোর আবহ তৈরি করার প্রভূত সুযোগ পান। কেউ ভয় দেখাতে পারেন কেউ পারেন না। কিন্তু লেখনীর মাধ্যমে গা ছমছমে আবহ তৈরি করা কিংবা এমন একটা আবহ তৈরি করা যেটা পড়ে মুহূর্তে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এমনটা কিন্তু সবাই পারেন না। শাক্যজিৎ পেরেছেন এবং সফল ভাবেই পেরেছেন । সূচনা থেকেই সেই আবহ তৈরি করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রাকৃতিক বর্ণনা এবং তার সাথে একটা অজানা ভয়ের আশঙ্কা। অদ্ভুত একটা গা শিরশিরানি অনুভূতি তিনি ধরে রাখেন সমগ্র প্রথম পর্ব জুড়ে। প্রথম পর্বে গল্প এমন জট পাকায় পাঠকের একসময় মনে হবে একটা লুপের মধ্যে যেন হারিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত। চোরাবালিতে গেঁথে যাওয়ার মতন। মনে হবে এই রহস্যের সমাধান কি আদৌ সম্ভব? কীকরে সম্ভব? যেখানে ঘটনা ঘটে গেছে বহু বছর আগে। তার অনেক ক্লু অনেক সাক্ষ্য প্রমাণই হারিয়ে গেছে। তার পরেও কি তনয়া পারবে এই রহস্যের কিনারা করতে?
হ্যা তনয়া। তনয়া ভট্টাচার্য। "শেষ মৃত পাখি" উপন্যাসের সেই সাংবাদিক আবারো ফিরে এসেছেন এই রহস্য কাহিনী তে। পেশায় তিনি গোয়েন্দা নন কিন্তু পূর্বের হত্যা রহস্যের সফলতায় তার উপর এখন মানুষের আস্থা বেড়েছে। তাই তাকে না চাইতেও জড়িয়ে পড়তে হয় কাহিনীর মায়াজালে। জড়িয়ে পড়তে হয় বারবারা, অ্যারন, এডওয়ার্ড, মনীষা, জেনিফার, ডলোরেস, মার্গারেট, ফ্রেডরিক, অবিনাশ, রেভারেন্ড সবার সাথে। আরো দুটি চরিত্র না থেকেও তনয়া কে ঘিরে ছিল সর্বদা, সেই ক্রিস এবং অ্যাগনেস।
উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে জট ছাড়ানোর পর্ব চলে। এই পর্বটি প্রথম পর্বের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু উত্তেজনার মাপকাঠি একই ছিল। অন্তত আমার কাছে তাই ছিল। "শেষ মৃত পাখি" - র সাথে সবকিছু তুলনা করলে হবে কেন? দুটো উপন্যাস তো একই রকম ভাবে এগিয়ে যেতে পারেনা। তাহলে আর পাঠকরা গ্রহণ করবেন কেন? এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে তনয়া শেষ অবধি যেই সিদ্ধান্তে আসেন সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত অভিমত। এই রহস্যের সমাধান কেউ অন্যরকম ভাবে করলেও করতে পারত সেটাও যে ঠিক বলতে পারি তা নয়। কারন পরে আমরা পাঠকরা জানতে পেরেছি তনয়া সত্যসন্ধানী হিসেবে কতটা সঠিক ছিল। তবু তার কাছে শেষ অবধি এক দুটো জিনিস অধরা রহস্য হয়েই থেকে যায় যেটা আমরা পাঠকেরা শেষে গিয়ে জানতে পারি কিন্তু তনয়া জানতে পারেন না। এটাই ওনার জন্যে একটু আক্ষেপ। কিছু ক্ষেত্রে না পাওয়া টাও হয়তো অনেক বেশি পাওয়া হয়ে যায়। যাদের কথা ভেবে তনয়া দিবারাত্র এক করেছে তারা তনয়া কে কাছে টেনেও ভুল বুঝে দূরে সরিয়েছে বারংবার। আর আগনেস? সেই কিশোরীটির কথা ভেবে হৃদয় মুচড়ে ওঠে প্রতি মুহূর্তে। কি পেলো মেয়েটি তার সারা জীবনে? এত আঘাত এত কষ্ট কি সত্যিই তার প্রাপ্য ছিল? কোথাও গিয়ে যেন অ্যাগনেসের এই ব্যথা এই যন্ত্রণা তনয়াকে ছুঁয়ে যায়।
"হা হা বাতাস , শাল সেগুনের প্রহরা ও নির্জন টিলা তোমাকে মনে করাবে মৃত সমাধিদের কাহিনী।"
সত্যিই এই উপন্যাস শেষ করার পরেও মনে করাতে থাকে সেই গঞ্জ, সেই sanctuary homestay , সেই তিতিরকান্নার মাঠ, রহস্যঘেরা জলাভূমি ও জোহার হালে।
তনয়া কে আমরা নিশ্চই খুব শিগগিরই আবার পাবো শাক্যজিতের পরবর্তী রহস্য কাহিনী তে। কিন্তু "নৈশ অপেরা"— এই আবহ , এই মায়া কিন্তু আরো কিছুদিন ছড়িয়ে থাকবে দেহ মনে।
Comments
Post a Comment