নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'নৈশ অপেরা' পড়ে গুডরিডস্-এ মতামত জানিয়েছেন অভিষেক রায় বর্মণ। আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.............................................................
'শেষ মৃত পাখি'-র মতন অমন অনবদ্য, শুধু সাম্প্রতিক নয়, বলব বাংলায় লেখা তাবৎ গোয়েন্দাসাহিত্যে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমী সংযোজনের পর, সেই একই সিরিজের প্রকাশিতব্য উপন্যাস সম্বন্ধে তার রচয়িতার কাছে প্রত্যাশা ও শেষমেশ নিরাশ হওয়ার আশঙ্কা—দুটিই খুব উঁচুতারে বাঁধা থাকে। ইতিমধ্যে শাক্যজিতের লেখা পূর্বাপর অনেকগুলি ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধনিবন্ধ পড়ে ফেলি এবং মনে ভরসা জাগে যে, 'শে-মৃ-পা' অসময়ে উল্কাপাতের মত আকস্মিক কোনো দৈব অঘটন নয়—বরং একজন নিষ্ঠাবান গদ্যশিল্পীর দীর্ঘ অনুশীলন ও প্রস্তুতির যথাযোগ্য ফসল। এও বুঝতে পারি যে, সাহিত্যগুণের বিচারে, পশ্চিমবাংলার একালের গোয়েন্দাসাহিত্যে এক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক ছাড়া শাক্যজিতের সমকক্ষ কেউ নেই। কাজেই প্রত্যাশা আরো প্রশ্রয় পায়।
আপাতত 'নৈশ অপেরা' পড়ে আমি যুগপৎ বিস্মিত ও বিহ্বল। এ-কাহিনি কি কেবল 'শে-মৃ-পা'-র যোগ্য উত্তরপর্ব নাকি সাহিত্যগুণে তার চেয়েও স্বতন্ত্র ও উৎকৃষ্ট—তার বিচার হয়তো এই বিহ্বলদশা কাটলে করাই ভালো। এটুকু বলাই যায়— শাক্যজিতের গদ্যের কাব্যময় কারুকার্য; আখ্যানকে বিচিত্র শাখাপ্রশাখায় বিন্যস্ত করে স্থান ও কালের মাত্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত সুদূরবর্তী সূত্রগুলোকে পরস্পরের কাছাকাছি আনার সাবলীলতা; উপরন্তু ঘনবাস্তবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে ঘটনাপরম্পরায় ছন্দ, দ্রুতি, গভীরতা এবং চরিত্রদের প্রতি সমবেদনা রাগ দুঃখ দ্বেষের স্ববিরোধী রসায়নকে গাঢ় করে আনার যে নৈপুণ্য দেখিয়ে শে-মৃ-পা আমাদের আবিষ্ট করেছিল—তা 'নৈশ অপেরা'তেও স্বমহিমায় বহাল। যদিও, উত্তমপুরুষে একই চরিত্রের বিভিন্ন বয়েসের কথন-কে কোনো অধ্যায় বা পরিচ্ছেদে ভাগ না করে যেভাবে কুরুশের মতই বুনে দেওয়া হয় পরপর—তাতে 'শে-মৃ-পা'-র তুলনায় 'ডেরেক এখানে বসে আছে'-র কথাই মনে আসে বেশি।
বিষয়বস্তুর নিরিখে মোটা দাগের মিল রয়েছে 'একানড়ে', 'শে-মৃ-পা' এবং 'ডেরেক'-এর সঙ্গে ('বীরেশ্বর সামন্ত হত্যারহস্য' এখনও পড়িনি)—মেট্রোপলিস থেকে দূরে ক্ষয়িষ্ণু জনপদে কয়েক দশক আগে ঘটে যাওয়া অপরাধ—পুলিশ যার মীমাংসা করতে পারেনি—এবং সেই অমীমাংসিত অপরাধের প্রায়শ্চিত্তকল্পে এবং পরোক্ষ পাপবোধ-জনিত আত্মক্ষয়ে একটি গোষ্ঠীর বিভিন্ন মানুষ অকালে জরাপ্রাপ্ত হন, স্বাভাবিক জীবনস্রোতের বাইরে ছিটকে পড়েন, অথবা উন্মাদ হয়ে যান। শাক্যজিতের এই লেখাগুলির থিম হিসেবে যদি কয়েকটি শব্দ বেছে নিতে বলা হয় তবে আমি বলব—স্মৃতিভার, নৈরাশ্য, গিল্ট, রিপ্রেশন। স্মৃতির বিশ্বাসঘাতকতা এবং পাপীর নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা—এই দুয়ের সঙ্গে যুঝে সত্যকে বের করে আনতে প্রয়োজন ইতিহাসবিদ, মনোবিশ্লেষক অথবা চিহ্নতাত্ত্বিকের দৃষ্টি ও হেঁশেলে ঢোকা বিড়ালের ক্ষিপ্রতা।
মিথ্যে ও কল্পনার গাদায় ছানবিন করে সত্যকে খুঁজে বের করাই তো হুঁশিয়ার গোয়েন্দার কাজ— কেবল এটুকু ধরলে ধ্রুপদী গোয়েন্দাকাহিনির সঙ্গে শাক্যজিতের উপন্যাসের মিল খুঁজে পাওয়াই স্বাভাবিক—কিন্তু একটা বড় পার্থক্য, যেটা শাক্যজিতের লেখার একটি দার্শনিক এবং রাজনৈতিক প্রস্থানও হয়তো—তা হল, গোয়েন্দাপ্রবর হোমস, পোয়ারো, ফেলুদা, ব্যোমকেশ বা হাল আমলের অনেক সত্যান্বেষীরা (কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে) যখন রহস্যভেদ করেন তখন তার সুফল হিসেবে সংসারে ভারসাম্য ফিরে আসে, একটি ছোট্ট সমস্যার যুক্তিসম্মত সমাধান আমাদের আন্তরিক তৃপ্তি দেয়, তার নেপথ্যে ঢাকা পড়ে যায় সভ্যতার সামুহিক সংকট, সমাজ-ইতিহাসের ক্ষতবিক্ষত প্রেক্ষিত।
এদিকে শাক্যজিতের উপন্যাসে যখন রহস্যভেদ হয় তখন সংসারে কোনো ভারসাম্য তো ফেরেই না, বরং উপন্যাসের সব চরিত্র এবং পাঠক স্বয়ং যেন শেষ অবলম্বনটুকু হারিয়ে দিশেহারা বোধ করে। নরহত্যার যে অপরাধ, তার কালপ্রিট-কে খুঁজতে গিয়ে যে মর্মান্তিক বিপর্যয়ের ইতিহাস বেরিয়ে পড়ে বীভৎসতা ও কারুণ্যে মথিত হয়ে, তা দেখে আর নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জোগায় না; দ্বিগুণ পাপবোধ, বিলাপ, হা-হুতাশ এসে গিলে খায় মনের চরাচর। পাঠক হিসেবে যদি বলি মীমাংসা না হলেই বোধহয় ভালো হত তা হলে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু সত্যান্বেষণের ঠেলায় যে পরিমাণ ঘৃণা, অপমান ও অত্যাচারের যন্ত্রণা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তা অসহনীয়, কারণ পাপী ও অপাপবিদ্ধ সব চরিত্রই ততক্ষণে আমাদের চোখে রক্তমাংসের মানুষ—তাদের শরীর বা আত্মার মৃত্যু ও পচন দেখে আমরা আর নির্বিকার থাকতে পারি কই? (বস্তুত, নৈশ অপেরার প্রথম পর্বের কিছুটা পড়ে মনে হয়েছিল এই চরিত্ররা আসলে সকলেই হয়তো মরে ভূত হয়ে গেছে কিন্তু সেটা এখনও তাদের অজানা—হুয়ান রুলফোর 'পেদ্রো পারামো' উপন্যাসের সেই আগন্তুকের মত) রহস্যসমাধানের সাফল্যেও তাই কোনো তৃপ্তি পাওয়ার কথা নয়। হয়তো সেজন্যই সিরিজের দুটো উপন্যাসেই শেষমেশ তনয়া, যিনি সত্যান্বেষী, তিনি যেন অকুস্থল থেকে বেরোতে পারলে বেঁচে যান!
শাক্যজিতের সব লেখাই যেন এক চরাচরব্যাপী শোক আর তাকে মুছে ফেলার সিসিফীয় প্রয়াসের ধারাবিবরণী; পরিত্রাণহীন নিরীশ্বর এই পৃথিবীতে নশ্বর মানুষের হাহাকারের নথি—যা আমাদের বিহ্বল ও নিরুপায় করে ছাড়ে। এখানে যদি কোনো আশার ঝলক থাকে, তবে তা রহস্য সমাধানের সম্ভাবনায় নেই; তা আছে (পাকেচক্রে) গোয়েন্দা তনয়ার চরিত্রচিত্রণে— তার মানবিকতায়— অপরাধের নির্মম সত্যকে খুঁজে বের করে, অপরাধীর ইতিহাস জেনে যাওয়ার পরেও তার প্রতি সমব্যথী হওয়ার অমূল্য সংবেদে।
..............................................
নৈশ অপেরা
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment