নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'নৈশ অপেরা' পড়ে মতামত জানিয়েছেন মৌসুমী চক্রবর্তী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.........................................................
নৈশ অপেরা
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য: ৫৪০/-
পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে
সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।
—১৯৪৬-৪৭,জীবনানন্দ দাশ
… সুতরাং কিশোরী অ্যাগনেস ও’ব্রায়েন-কেও একদিন হারিয়ে যেতে হয়।
এবং এডওয়ার্ড ব্রাউন খুন হয়,ক্রিস ব্রায়ান অপহৃত হয়,মুন্না মারা যায় বা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়,ডেভিড ব্রাউন ও মনীষা ব্রাউন আত্মহত্যা করে। এবং ‘শেষ মৃত পাখি’র ব্রিলিয়ান্ট ডেবিউর তিনবছর পর তনয়ার সঙ্গে পাঠকের অপেক্ষিত দ্বিতীয় সাক্ষাৎটি ঘটে ঝাড়খণ্ডের টিলা-ঝোরা-জঙ্গল-ঘাসবন ও অরণ্যের ঝাঁঝরা অশেষ মৃতদেহ সম্বলিত গঞ্জের জীবন্ত ফসিলের অভয়ারণ্যে। তনয়া আসেন,ছেড়ে যান এবং ছেড়ে গিয়েও আবার ফিরে আসেন গঞ্জের নন-লিনিয়ার সময়প্রদেশে ক্রমাগত মানুষের নেই হয়ে যাওয়ার সত্যি খুঁড়ে বের করতে।
অতিপ্রাচীন মালভূমি ও উপত্যকা যারা মহাদেশের জন্ম দেখেছে,যেখানে প্রাগৈতিহাসিক গাছেদের প্রেতশিকড়ের গা বেয়ে সবুজ অন্ধকার ওঠে মাটি ফুঁড়ে,সেখানের ফ্লাকচুয়েটিং স্মৃতি ও আচ্ছন্ন জনমানস,অসুখাক্রান্ত শৈশব ও বিক্ষত বেঁচে থাকা এবং অনস্তিত্বের আশ্চর্য পৃথিবী উপন্যাসের প্রথম পর্ব জুড়ে প্রত্যেকের দিন রাত্রি গোধূলি ও শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়। আবহ নির্মাণ এত সাবলীল যে অনায়াস নিরাবেগে নিশির ডাকের মতো হাতছানি রেখে যায়। যেহেতু তনয়া শুরু থেকে শেষ অবধি মূলত সন্ধানী,অকাট্য ঈশ্বর হওয়ার দায় তাঁর নেই,সেই কারণে বারবারা-অ্যারন-জেনিফার-অবিনাশ যাদব-আলফ্রেড হেমব্রম ও গঞ্জের অন্যান্যদের মতো তনয়াও ‘নৈশ অপেরা’র অন্যতম ন্যারেটর। কাহিনীর দূর অতীত,অনতিদূর অতীত ও বর্তমান আসলে এদের বিবিধ ন্যারেটিভ,প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অনুভূতি অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। পাঠক এদের সঙ্গে সামিল হয়ে পড়ে গঞ্জের গোলকধাঁধার মতো অ্যানাটমির ভিতর। সময়ের পেটের ভিতর আরেক সময়,তার ভিতর আরেক। ষাটের দশক-আশির দশক,যখন গঞ্জের অ্যাংলো কমিউনিটির ভালো সময়,পঁচাশি সাল থেকে নব্বইয়ের দশক,যখন অ্যাগনেস ও ক্রিস হারিয়ে যায় এবং কমিউনিটির উপসংহারের শুরু হয়,আরও যা শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়,এই সব আলাদা আলাদা কালখণ্ড,এমনকি অ্যাগনেসের নিজের সময়ও অ্যাগনেসের অনস্তিত্বের ভার বহন করে,যা তার উচ্ছলতার আনন্দের বিষাদের একদিন দু’দিন কিংবা কয়েক মাস পরের ঘটনা,অ্যাগনেসের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা,কিন্তু যে কোনো সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় ঘটে গেছে,ঐ একটি ঘটনাই চিরকালের মতো ঘটে আছে।
‘নৈশ অপেরা’র সময় আদতে ভাঙনের দিকনির্দেশ। প্রথম পর্বে যদিও গা-ছমছমে রহস্য,তবু তলায় তলায় স্রোত বয় অনপনেয় শোকের। তনয়া নির্ধারণ করেন তিনি কী খুঁজবেন — যারা হারিয়ে যায় তারা কেন হারিয়ে যায়। অ্যাগনেস হারিয়ে গিয়েছিল বলেই কি ক্রিসকেও হারিয়ে যেতে হয়?
লীন হয়ে গেলে তারা তখন তো — মৃত।
মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো।
মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?
---১৯৪৬-৪৭,জীবনানন্দ দাশ
মানুষের ইতিহাসে এমন অতীত নেই যখন সবলের মুঠো দুর্বলের শ্বাসরোধ করেনি। গঞ্জের নিজস্ব জাতিবৈষম্য শ্রেণিবৈষম্য লিঙ্গবৈষম্য ইত্যাদি যাবতীয় অসাম্যের সমীকরণ উপাদান সেই প্রাথমিক অপরাধেরই,কারণ সব অপরাধ শেষমেশ একটি গল্পেরই পুনরাবৃত্তি। সবল বনাম দুর্বল এই সমীকরণ লক্ষ বছরেও বদলায়নি,বদলে যায় শুধু অবস্থান। প্রশ্ন রয়ে যায় — শুরু কোথায়? শুরু না জানলে নির্ধারণ করা যায় না অন্যায়কারী কে,প্রতিশোধ কার। দ্বিতীয় পর্ব সেই উৎসের দলিল এবং যেহেতু তনয়া শুরু থেকে শেষ অবধি সন্ধানী,ফলত তনয়া ধূসর ভঙ্গুর যে সূত্রগুলো ক্ষয়ের ডিপ্রেসিভ গন্ধ ছাড়ে,সেগুলোকে মিলিয়ে সম্ভাব্য সবথেকে সহজ কার্যকারণ দাখিল করেন। আমরা পাঠকরা,যারা ‘শেষ মৃত পাখি’র সেরিব্রাল উজ্জ্বলতায় বিস্মিত হয়েছিলাম,তাদের কাছে ‘নৈশ অপেরা’র সমাধান তুলনায় সহজ ও অনুত্তেজক লাগতে পারে। মনে হতে পারে যেসব হারিয়ে যাওয়ার বিষ-অভিঘাতে গোটা গঞ্জ ও তার প্রজন্মরা দীর্ঘ পরিণতিহীন মৃত্যু পেতে পারে,সেই সব নিরুদ্দেশের ‘কীভাবে’ ও ‘কেন’ আরও শকিং হল না কেন। বুদ্ধির খেলা শুরু হওয়ার আগেই যেন মঞ্চে পর্দা পড়ে গেল।
কিন্তু আমরা কি জানি না,যে সমাজ জানে না মেয়েদের কীভাবে হ্যান্ডল করতে হয়,সেই সমাজে অ্যাগনেসরা কেন হারিয়ে যায়। আমরা তো জানি অ্যাগনেস প্রথম নয়,তার আগে ও পরে মানুষের পদচিহ্নের আদি থেকে আজ অবধি অনেকানেক মেয়েদের নেই হয়ে যাওয়াই প্রথা। যে অপরাধ নতুন নয় এবং যার উপশম নেই,সেই অন্যায়ের স্মৃতি আমাদের অবচেতনে বয়ে এনেছি, ‘নৈশ অপেরা’ সেই সুতোয় টান দেয় অনাড়ম্বরে,শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের পরিচিত নির্মোহতায়। স্তব্ধ হয়ে ভাবি,এই উপন্যাসের আঘাত আমি হৃদয়ে বয়ে বেড়াব ভাস্কর্যের মতো। অ্যাগনেসের জন্য যতবার বেদনা অনুভব করব,মনে হবে একটি রহস্য কাহিনি আমায় জীবনানন্দের আরেকটু কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।
তনয়ার দায় নেই অকাট্য ঈশ্বর হওয়ার,সুতরাং উপন্যাসের উপসংহার জানান দেয়,তনয়া একশো শতাংশ সঠিক নাও হতে পারেন। পাঠক হিসেবে আমি চাই,গঞ্জের অমীমাংসিত রহস্যগুলোর অন্তত একটি সমাধানে তাঁর সিদ্ধান্ত ভুল হোক। তনয়া ঘোষণা করেন,অ্যাগনেস নেই। অ্যাগনেসের ভূত আসলে মাস হ্যালুসিনেশন কিংবা সাজানো ভূত। পাঠক হিসেবে আমি জানি, ‘নৈশ অপেরা’র ক্ষয় শাপ ও শোকের ক্রনিকলে অ্যাগনেসের ভূত আমার সালভেশন। কারণ,ক্রমাগত অন্যায় অবিচার ও অত্যাচার তাকে নিঃশেষে মুছে দিল,এর চাইতে বিধ্বংসী অন্যায় আর কিছু নেই।
‘মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?’
উপন্যাস কোথাও কি লুকনো নীরব প্রশ্ন রেখে যায়?
সৌজন্য চক্রবর্ত্তীর প্রচ্ছদ প্রশংসনীয়। মুদ্রণ-প্রমাদ নগণ্য।
পরিশেষে লেখককে অভিনন্দন। তনয়া আবার ফিরবেন এবং আরেকটি দুর্দান্ত মানবিক কাহিনি পাঠককে উপহার দেবেন অপেক্ষা রাখি।
Comments
Post a Comment