পথ মিশে যায় মিশনবাড়ি ।। (নদীয়া জেলার খ্রিস্টমেলা)।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ।।

"তখনও কৃষ্ণনগর শহরটা গড়ে ওঠেনি। প্রাচীন নদীয়া বা নবদ্বীপের কাছেই ছিল 'রেউই' নামে একটি গ্রাম। মূলত গোপ বা গোয়ালাদের বাস। এই গোপদের আরাধ্য ছিল কৃষ্ণ। ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, জলঙ্গী নদীর দক্ষিণ ধারে গড়ে ওঠা এই জনপদে ভবানন্দ মজুমদারের পুত্র রাঘব রায় মাটিয়ারি থেকে বাস তুলে বসতি গড়ে তুললেন রেউই গ্রামে। ভবানন্দ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে রাজা খেতাব পেয়েছিলেন। ফলে বংশানুক্রমিকভাবে তারা রাজা হয়ে গেলেন। রাঘব রায় তৈরি করলেন রাজবাড়ি। তারই ছেলে রুদ্র রায় গোপদের মহাসমারোহে কৃষ্ণপূজা দেখে এবং কৃষ্ণের প্রতি নদীয়াবাসীর ভক্তি দেখে গ্রামের নাম দিলেন 'কৃষনগর'। গড়ে তুললেন রাজধানী করে।

বাংলায় পর্তুগিজ আগমন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রসারের প্রাক্কালে নদীয়া বা কৃষ্ণনগরে খ্রিস্টধর্মের অস্তিত্ব ছিল না। ১৮৩২ সালে নদীয়ার চাপড়া অঞ্চলে প্রোটেস্ট্যান্ট মতাবলম্বী সি এম এস বা চার্চ মিশনারি সোসাইটির পুরোহিত রেভা দিরে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। কৃষ্ণনগরেও তখন প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রভাব রয়েছে। এই শহরে ক্যাথলিক মিশনারিদের প্রথম পদার্পণের খবর পাওয়া যায় ১৮৪৫ সালে। ফাদার জুবিবুরু নামে এক ক্যাথলিক মিশনারি ১৮৪৫ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর আসেন। পুরো নাম ফাদার টমাস জুবিবুরু। স্পেনের মানুষ। কার্মেলাইট ধর্মসংঘের সদস্য। তিনি প্রথম পর্যায়ে এসে ১৯ জন প্রোটেস্টান্টকে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনিই অর্থসংগ্রহ করে একটি ক্যাথলিক গির্জা নির্মাণ করেন। ১৮৪৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এই উপাসনালয়ের উদ্বোধন হয়। নাম দেওয়া হয় 'কার্মেলের মাতা মারিয়ার গির্জা'।

এ পর্যন্ত বলে পরাশর চায়ের কাপে চুমুক দিল। বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ধুতির খুট দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বলে, 'তা না হয় বুঝলাম। তা এই রমরমা হল কী করে?'

—তারও ইতিহাস আছে খুড়ো। একদিনে তো আর হয়নি। সে বিরাট গল্পো তোমায় বরং কেটেকুটে বলি।

—তাই বলো বাপ। অ্যাতো লম্বা-চওড়া ফদ্দ শুনে কী লাভ?

পরাশর আবার শুরু করল।

তখন ক্যাথলিক পুরোহিতরা প্রোটেস্ট্যান্ট মতালম্বীদের মধ্যেই ধর্মপ্রচার করতে শুরু করলেন। তাদেরই নিয়ে এলেন ক্যাথলিক গির্জায়। নতুন করে বাপ্তিস্ম বা জলদীক্ষা দিয়ে ক্যাথলিক করে তোলা হলো। ফাদার জুবিবুরু গ্রামের দিকে মন দিলেন। পাথুরিয়া, ভাদগাছি, হাটখোলা, মুন্সিপুর, কুতুবপুর এসব অঞ্চলে প্রচার করতেন। এগুলো এখন সবই বাংলাদেশে সীমান্তের আসেপাশে ছড়িয়ে আছে। কুতুবপুর পড়েছে ওপারে। আর হাটখোলা, মুন্সিপুর এপারে। এই সব গ্রামে এখন মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি। তা জুবিবুরুর স্বাস্থ্য ভেঙে গেল। তার উপর প্রোটেস্টান্টরা তাঁকে বাধা দিল। ফলে অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে উঠল। ফাদার জুবিবুরু কৃষ্ণনগর ছেড়ে কলকাতায় ফিরে গেলেন। আর গির্জেটা পড়ে রইল। বহরমপুর থেকে ফাদার ভারাল্লি নামে এক পুরোহিত মাঝে মাঝে এসে এখানকার ক্যাথলিকদের দেখে যান। প্রয়োজন হলে দীক্ষা দেন।

তা এরই মধ্যে শহরে কলেরা মহামারী রূপে দেখা দিল। ক্যাথলিক গির্জাটি তো পড়েই থাকে। তা শহরের মান্যগণ্য লোকেরা কলকাতায় আর্চ বিশপ কেরুকে অনুরোধ করলেন গির্জাঘরটি হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হোক। আর্চ বিশপ কেরু সানন্দে মত দিলেন। গির্জাঘর হয়ে গেল হাসপাতাল। অবশ্য অস্থায়ী। শহরের কর্তৃপক্ষ আর্চ বিশপকে বললেন, গির্জাঘরটি তো ব্যবহার করা হয় না। ওটা বিক্রি করে দেওয়া হোক। কিন্তু আর্চ বিশপ রাজি হলেন না। শহরের অবস্থা ভাল হয়ে গেল। হাসপাতাল উঠে গেল। গির্জাঘরটি ভাঙা অবস্থায় পড়ে রইল। ক্যাথলিকদের বেশিরভাগই আবার প্রোটেস্ট্যান্ট হয়ে গিয়েছে। তা কে আর উপাসনা করবে বলো।

তারপর তো ইতালির মিলান থেকে এলেন মিলান ফাদাররা। সে ১৮৫৭ সালের কথা। সিপাহী বিদ্রোহের সময়। ফাদার লিমানা নামে এক পুরোহিত এলেন। কিন্তু থাকবেন কোথায়? সরকারি ডাকবাংলোতেই থাকতে আরম্ভ করলেন। মাস তিনেকের মধ্যে গির্জার পাশেই ঘর তুলে নিলেন। গির্জাঘরটি সারিয়ে নিলেন। তিনি ভাবলেন সব ক্যাথলিকদের এক জায়গায় থাকা দরকার। ক্যাথলিক কলোনি করার জন্য একটা বিরাট জমি কিনে ক্যাথলিক বসতি গড়ে তুললেন। সেটাই আজকের খ্রিস্টান পাড়া বা রোমান ক্যাথলিক পাড়া। লোকের মুখে আর সি পাড়া। এভাবেই মিলান ফাদারদের উৎসাহে কৃষ্ণনগরে ক্যাথলিক সংখ্যা বাড়তে লাগল।

যা হোক, এভাবেই চলছিল। কিছু কিছু ক্যাথলিক বাড়ছিল। কিন্তু আমূল পরিবর্তন শুরু হল ১৮৮৬ সাল থেকে। সেই সময় ভারতে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের পরিচালনায় নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। রোমের পোপ ত্রয়োদশ লিও 'বিশপ তন্ত্র' প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই সময় খুলনা, যশোর, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, ফরিদপুর, রাজশাহী, বগুড়া, মালদহ, দিনাজপুর—এইসব জেলাগুলো নিয়ে হলো কৃষ্ণনগর মহাধর্মপ্রদেশ বা ডাইয়োসিস। কৃষ্ণনগরের দায়িত্বে থাকা মনসিনিয়র বা উপধর্মপাল ফ্রান্সিসকো পৎসিকে বিশপ পদে অভিষিক্ত করা হলো। তিনি গির্জার পাশে ফাদারদের থাকার জন্য একটা দোতলা বাড়ি তৈরি করলেন। তখনও তো ফাদাররা ওই বাড়িতেই থাকেন। তৈরি করলেন বিশপ ভবন। ওই যে গো, লাল রঙের যে দোতলা, যাকে তোমরা 'বিশপ হাউস' বলতে, বিশপ মরো, বিশপ মতি বাড়ৈ থাকতেন, ঐটিই তৈরি করেছিলেন বিশপ পৎসি। তাঁর কবর তো গির্জার মধ্যেই আছে। এর মধ্যে হলো কী, ১৮৯৭ সালে কৃষ্ণনগরের বিরাট ভূমিকম্প হলো। গির্জাঘরটি গেল ভেঙে। আবার নতুন করে শুরু হলো। বিশপ পৎসি গির্জাঘরটি নতুন করে তৈরি করলেন। বড় গির্জা হলো।

—আচ্ছা বাপ, গির্জার মধ্যে যে চারকোণা থাম আছে, ওটাই কি বিশপ পৎসি করেছিলেন? আমিও এমন শুনেছি।

—ঠিক তাই। যতদূর পর্যন্ত চারকোণা থাম আছে, ওই পর্যন্ত বিশপ পৎসি তৈরি করান। তা নতুন গির্জা হলো। খ্রিস্টান পাড়ায় বাড়ি করে মানুষ বাস করতে শুরু করলো। ক্যাথলিকদের সংখ্যা বাড়ল। ও পাশে খ্রিস্টানদের বাড়ি, স্কুল সব তৈরি হলো। মানে জমজমাট অবস্থা।

বৃদ্ধের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। বলে, 'তার মানে তখন থেকেই বড়দিনের মেলা শুরু হলো?'

—হতে পারে। পরাশর উত্তর দেয়। বিশপ পৎসির সময় থেকেই ক্যাথলিকদের জাঁক বাড়তে থাকে। বড়দিন উৎসবের রমরমাও তখন থেকে। মিলান ফাদাররাও ক্যাথলিকদের উন্নতির জন্যে কাজ করতেন। ইতিহাসে দেখতে পাচ্ছি, শহরের সমস্ত ধর্মের মানুষ বিশপ পৎসিকে শ্রদ্ধা করত। তিনি যেমন ছিলেন ধার্মিক, তেমনি ছিলেন মিশুকে। ১৯০১ সালে বিশব পৎসির পুরোহিত জীবনের ৫০ বছর উদযাপিত হলো। সারা শহর জুড়ে হল বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা। কৃষ্ণনগরের মহারাজা ঘোড়ার গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। তাতেই বসেছিলেন বিশপ। শোভাযাত্রায় রাজা নিজে ছিলেন। শহরের বহু গণ্যমান্য মানুষ শোভাযাত্রায় অংশ নেন। এমন কি তিনি যেদিন মারা যান, শহরের সমস্ত সরকারি আদালত, অফিস-কাছারি, স্কুল, এমন কি দোকান-বাজারও বন্ধ ছিল। গির্জার ভিতর যখন তাঁকে কবর দেওয়া হয় তখন কী ভিড়। সমস্ত ধর্ম কী জাতির মানুষ, সে ধনীই হোক কি গরীব, ক্যাথলিক-অ-ক্যাথলিক প্রচুর মানুষ এসে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে যান।

—আচ্ছা বাপ, সে কোন সময়?

—১৯০৫ সালের ২২ অক্টোবর তিনি মারা যান। তা হলেই বোঝো খুড়ো, তাঁর সময়েই যদি মেলা শুরু হয়ে যায়, অবান্তর কি হবে? এই দ্যাখো না, ইতালিয়ান ফাদাররা তো বড়দিনের সময় কম জাঁক করতেন না। সেই সময় মিলান ফাদাররা যখন ছিলেন, তাঁরাও গির্জা সাজাতেন, গির্জার বাইরে পতাকা টাঙানো হতো, গোশালা হতো। তুমি তো তোমার ছোটবেলাতেই দেখেছ খুড়ো।

—তা তো দেকেচি।

—তা ধরো, বড়দিনের সময় মানুষ আসত গির্জা দেখতে। মানুষের ভিড় হতো। তা যেখানে মানুষের ভিড়, সেখানে দু-চারটে দোকান বসবে না? ধরো বাদাম ভাজা, বেলুন, দু-চারটে হ্যালাফ্যালা। এই করতে করতে গির্জার সামনের মাঠটা ভরে উঠত। জমতে জমতে একেবারে মেলা হয়ে গেল। বড়দিনের মেলার একটা নাম-ডাক হলো।

—তা তো ঠিক। তবে আমার কী মনে হয় জানো বাপ, বিশপ মরোর সময়েই মেলা রমরম করে উঠলো।

—একদম ঠিক কথা। তাও তো কম দিন হল না। ধরো সে ১৯৩৯ সালের কথা।"
...............................................................

পথ মিশে যায় মিশনবাড়ি
(নদীয়া জেলার খ্রিস্টমেলা)
সমরেন্দ্র মণ্ডল 

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী 

মুদ্রিত মূল্য : ১৫০ টাকা

সুপ্রকাশ



           

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।