লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

"মেজো জ্যাঠামশাইদের নবপ্রভাত মুদ্রণালয় ছাড়াও কুঠিডাঙায় তখন অনেকগুলি প্রিন্টিংপ্রেস। শুধুমাত্র কুঠিডাঙা মোড়ের আশেপাশেই আট-নটি প্রেস ছিল। তারই একটি—ভারতী প্রেসে আমাদের ছোড়দি হেড কম্পোজিটরের কাজ করত।

ছোড়দি মেজো জ্যাঠামশাইয়ের মেজো মেয়ে, সে কী করে ছোড়দি হলো তা বলা মুশকিল। আসলে বড়ো, মেজো, সেজোর পরে পরিবারের চতুর্থ কন্যা ছোড়দি। তার পরের দিদিরা ফুল, ন, লাল, চিনি, ভালো, সুন্দর—ইত্যাকার অভিধায় না-কুলোনোয় নামের পেছনে দিদি লাগিয়ে ডাকা হতো—পুটিদি, কুটিদি, ছুটিদি, ফুচুদি, রুণাদি ইত্যাদি। অন্য দিদিদের যথাসময়ে বিয়ে হলেও ছোড়দি বিয়ে করেনি। তার কারণ নিয়ে সে-সময় আমরা মাথা ঘামাইনি।

আমরা শুধু জানতাম লম্বা-চওড়া, শক্ত-সমর্থ, ঈষৎ পুরুষালি চেহারার আমাদের ছোড়দি হলো রিজিয়া সুলতানার মতো বীরাঙ্গনা এবং জ্ঞানের দিক দিয়ে ফরাসি এনসাইক্লোপিডিস্ট পণ্ডিতদের মতো জ্ঞানশালিনী, এবং ছোড়দি আমাদের কাছে ছিল চলমান ডিকশনারি। বাংলা আর ইংরেজি বানানের ব্যাপারে এত বড়ো রেডি-রেকনার আজও চোখে পড়েনি।

আমরা জানতাম ছোড়দি যত রাতেই বাড়ি ফিরুক না কেন বাড়িতে আনন্দের লহর বয়ে যাবে—আমরা ছোটোরা পাবো একটা করে লজেন্স, টফি, পেন্সিল বা রঙপেন্সিল জাতীয় কিছু একটা। আর যেদিন ছোড়দি প্রেস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকবে, সেদিন নিশ্চিতভাবে কুঠিডাঙা বাজারে ঢুকবার মুখে লতিফ চাচার দোকান থেকে আসবে মাংস—দুপুরবেলা আমাদের পাতে থাকবে দু-টুকরো মাংস, দু-টুকরো আলু আর লম্বা ঝোল। সেই খাওয়া তো বছরে দু-চারদিন। বাকি সবদিন ছোড়দি স্নান করে ফুটো ডাল দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে রুটি- তরকারি টিফিন নিয়ে সকাল ন-টায় চলে যেত প্রেসে—ফিরত রাত্রি নটার পরে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, শনিবার-রবিবার-ক্যালেন্ডারে ছুটির দিন-প্রত্যেকদিন একই রুটিন।

প্রেস নিয়ে জেনেটিক রোগে আমাদের প্রজন্মে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ছিল ছোড়দি। ছোটোবেলা থেকেই মেজো জ্যাঠামশাইয়ের টিফিন পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে তার নাকি অসম্ভব উৎসাহ ছিল। নবভারত প্রেসে যাতায়াত করতে করতেই সকলের অলক্ষে ছোড়দি প্রেসের কাজ কিছুটা শিখে নিয়েছিল।

কয়েক বছরে হয়েছে হেড কম্পোজিটর—প্রতিদিন ওভারটাইম করত বলেই ভাই-বোনেদের লজেন্স দেওয়ার মতো জমিদারি মেজাজ বজায় রাখতে পেরেছিল। ছোড়দির হাত থেকে টাকা নেওয়ার সময় বড়োমা প্রত্যেকবার বলতেন—'এত পরিশ্রম করিস না ধীরা, রোববারটা অন্তত বাড়িতে থাক। যেদিন তুই বিছানায় শুবি সেদিন বুঝবি মজা। চুলগুলোকে তো করেছিস কাকের বাসা—একটু যে তেল দিয়ে বেঁধে দেবো সে-ফুরসৎ নেই তোর!'

ছোড়দি হেসে বলত— 'আমাকে নিয়ে তোমার অত দুশ্চিন্তার কী আছে? আমাকে তো আর ছেলে-পক্ষের মন ভুলিয়ে বিয়ে দিতে হবে না।' 

বলতে গেলে 'ঝঞ্ঝা-ঝড়-মৃত্যু-দুর্বিপাক'—যাই হোক না কেন ছোড়দির প্রেস কামাই নেই! সম্ভবত পঞ্চাশের দশকে শ্যামল গুহর লেখা ও সুরারোপিত ঐ গানটি আমরা ছোড়দির মুখেই শুনতে পেতাম।

বাড়িতে থাকার জন্য, ছুটি নেওয়ার জন্য অপোগণ্ড ভাই-বোনেরা বায়না করলে ছোড়দি বলত—'আমার টার্গেট কী বলতো? বাবাকে আর জ্যেঠুকে একটা প্রেস করে দেওয়া—তাই তো এত খাটছি!'

এই লক্ষ্য নিয়েই তুখোড় ছাত্রী ছোড়দি ম্যাট্রিকুলেশন বা সেকালের স্কুল ফাইনাল পাশ করে প্রি-ইউতে ভর্তি না হয়ে প্রেসের কম্পোজিটর হয়েছিল।

বাড়ির ছোটোরা তো দেখিইনি, ছোড়দিও ভালোভাবে মনে করতে পারে না—আমাদেরও একটা আস্ত প্রেস ছিল। সেটাই ছিল কুঠিডাঙার প্রথম প্রেস। একদা বড়ো জ্যাঠামশাই, মেজো জ্যাঠামশাই আর বাবা মিলে প্রেসটা চালাতেন।

প্রেসের মালিকানা থাকলেও একটি বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের পর্যাপ্ত ওয়ার্কিং-ক্যাপিটাল বা লগ্নি করার মতো নগদ টাকা ছিল না। পারিবারিক প্রেসটি যখন হাতছাড়া হয় তখন ছোড়দি খুবই ছোটো। মেজোমার কী একটা দুরারোগ্য অসুখ করেছিল। তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রেসটা প্রথমে বন্ধক রাখতে হয়, তারপর মেজোমা সেরে ওঠেন বটে কিন্তু দেনা ও সুদের দায়ে প্রেসটা বিক্রি করে দিতে হয়।

—বড়ো জ্যাঠামশাই যান পরের দুয়ারে চাকরি খুঁজতে, স্কুলের মাস্টার হতে, বাবা চাকরি নেন সাপ্তাহিক পত্রিকার দপ্তরে, মেজো জ্যাঠামশাই নিজের সাধের প্রেস হারিয়ে নবপ্রভাত মুদ্রণালয়ের মতো পরের প্রেসে কম্পোজিটরের চাকরি নেন। তার চেয়ে বড়ো কথা হলো—নবপ্রভাতের মালিক নব্যেন্দুকাকা নাকি একদা আমাদের প্রেসেরই কর্মচারী ছিলেন, মেজো জ্যাঠামশাইয়ের কাছেই কাজ শিখেছিলেন!

নিজের স্ত্রীর অসুখে পারিবারিক প্রেসটি বিকিয়ে যাওয়ায় মেজো জ্যাঠামশাইয়ের দুঃখ ছিল, সংকোচে ভুগতেন তিনি। মাঝে মাঝেই বলতেন—'বুঝলি ধীরা, নিজেদের একটা প্রেস যদি করতে পারতাম তাহলে বাপে-ঝিয়ে খাটতাম, সংসারে আর অভাব থাকত না। দাদাকেও এই বয়সে পরের দুয়ারে চাকরি করতে যেতে হতো না!'

সুতরাং ছোড়দি বাপের দুঃখ অপনোদন করার জন্য, পরিবারের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাণপণে খেটে যেত। অর্থাৎ ছোড়দি একটা স্বপ্নের পেছনে দৌড়াচ্ছিল। বহিঃকলকাতার ছোট্ট একটা প্রেসের হেড কম্পোজিটর পদ তো ছিল একটা গাল-ভরা নাম মাত্র। ছোড়দির রোজগার এমন ছিল না যে, সংসারে সাহায্য করে প্রেস কেনার মতো টাকা জমায় কিংবা নিজে একটা ভালো শাড়ি কিনে পরে কিংবা নিজের কোনো সখ-আহ্লাদ মিটায়।

কিন্তু তনখাইয়া স্বভাব ছিল পরিবারের রক্তে। ছোড়দি শুধু হেড কম্পোজিটরই ছিল না, ছিল কুঠিডাঙা প্রেস কর্মচারী সমিতির পাণ্ডা। সব সময়েই কোনো না কোনো প্রেসে কাজের পরিমাণ ও পাওনা-গণ্ডার হিসেব নিয়ে মালিকদের সঙ্গে কর্মচারীদের খটাখটি লেগেই থাকত। সেসবের সমাধান, সালিশি, আন্দোলন—সবেতেই ছোড়দির উৎসাহ ছিল প্রবল।

শুধু ছোড়দি নয়, লেটারপ্রেসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মহিলা কম্পোজিটর ছিলেন। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে মেয়েদের উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ছিল না। মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার ছিল না অধিকাংশ প্রেসেই। কোথাও কোথাও নিরাপত্তার অভাববোধও ছিল। ছোড়দি কুঠিডাঙায় মেয়ে কম্পোজিটরদের কাজের পরিবেশের উন্নয়ন এবং সমকাজে সমমজুরির দাবিতে সোচ্চার ছিল। এবং প্রায় প্রত্যেক প্রেসেই মেয়েদের আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল।

অন্যায় ফাঁকিবাজি আর কর্মীদের সঙ্গে মালিকের না-হক দুর্ব্যবহার, কারণ না-দেখিয়ে, শ্রম আইন না মেনে বরখাস্ত করার বিষয়গুলি ছোড়দি কখনই মেনে নিতে পারত না। প্রতি বছরই পুজোর আগে বোনাসের পরিমাণ নিয়ে লড়ালড়ি বেঁধে যেত। সুতরাং প্রতিবাদ না-করে থাকতে পারত না সে। কুঠিডাঙা ছোটো জায়গা, কিন্তু মুদ্রণ শিল্পের ক্ষেত্রে প্রায় গদাগের মতো! কুঠিডাঙার সকলেই ছোড়দিকে ভালো মতো চিনত।"
........................................
লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর
এক বিষাদান্ত পরম্পরা

অনন্ত জানা
....................................
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।