লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।
"পুরুষ-পরম্পরায় প্রায় এক শতকের লেটার-প্রিন্টিংপ্রেসের বা সাধারণ ছাপাখানার একটি বিশ্বস্ত ও প্রত্যক্ষ ছবি ছিল আমাদের বৃহৎ পরিবারের পরম্পরায় বেড়ে-ওঠা ভাই-বোনেদের কাছে। সে-অর্থে আমাদের পরিবারটিকে প্রেস-পরিবারই বলা চলত।
প্রেস, নিকট-অতীতের লেটার-প্রিন্টিংপ্রেস মানে কী? প্রেস মানে তো একটা পরিচিত সাদা-কালো ছবি!
মলিন ঘরে সস্তার কাঠের টেবিল, গুটিকতক চেয়ার, বেয়াড়া মাপের টুল অথবা নাতিদীর্ঘ বেঞ্চি—এই হলো সদর; আর অন্দরে আধো-অন্ধকার-সমাকীর্ণ একটি-দুটি ঘরে কালিমাচিহ্নিত দেওয়াল, মলিন চেহারার কয়েকটি নাতি-উচ্চ কেস-র্যাক—যেখানে ঢুকিয়ে রাখা টাইপ-কেস, ঢালওয়ালা কিন্তু চালাহীন কম্পোজ স্ট্যান্ডের ওপরে ও স্ট্যান্ড ঘিরে রক্ষিত টাইপ-ভর্তি চৌকোণা খোপওয়ালা কেসগুলো। প্রেসের আয়তন ও সামর্থ্য-অনুযায়ী এমন টাইপ-স্ট্যান্ডের সংখ্যা, প্রত্যেকটি স্ট্যান্ডের সামনে কাঠের টুল। ঢালওয়ালা অংশে সাড়াসাড়ি এবং সামনের অংশে আনুভূমির উপায়ে রক্ষিত টাইপ-কেসের সামনের টুলে কুলোর মতো পিঠ নিয়ে বসে থাকা কয়েকটি মানুষ। চারদিকে কালিমালিপ্তির বহুবিধ চিহ্নের মতোই তাঁদের হাতদুটি, তাঁদের বাঁ-হাতে কম্পোজিং স্টিক ডানহাতের দ্রুত চলাচল সঠিক টাইপের সন্ধানে টাইপকেসের কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে—মানুষগুলির আঙুলের ডগাগুলি সিসার কষাক্ত কালিমায় কর্মাক্ত। চারপাশের মালিন্যের মতোই মানুষগুলির মলিন-চেহারা। টাইপ-কেসের ওপর খোলা অবস্থায় ফেলা আছে হাতে-লেখা বাংলা বা ইংরেজি হলে টাইপড্ কপি। মানুষটির চোখ সেই চিন্তন ও সৃজনের দেমাকে গুরুভার অথবা ললিত-প্রসাদিত রচনার কপির দিকে। হাত চলেছে অভ্যস্ত নিখুঁত নিশানায়! সেই অনুজ্জ্বল আলোয় (এমন-কী বিজলি-আলো এসে যাবার পরও) দেখতে দেখতে এই বয়স-নির্বিশেষে অক্ষরবিন্যাসকারীদের অধিকাংশের চোখেই পরকলা।
বসার সদরে (যদি আদৌ সেই সংস্থান থাকে, তবে) কিংবা কম্পোজ-ঘরের কোণায়, দেওয়াল ঘেঁষে ছাপা ফর্মা বা ছাপার অপেক্ষায় থাকা নানান মাপের কাগজের স্তূপ। কোনো ঘরের কোণায় লম্বায়-চওড়ায় নানামাপের কাষ্ঠাধার বা ট্রে, গেলি বা গ্যালি; প্রত্যেকটি কম্পোজ স্ট্যান্ডে অক্ষরবিন্যাসকারীর হাতের পাশেও এমন গ্যালি রাখা। এই গ্যালির মহিমা অনেক। এর ওপরেই কম্পোজিটর কম্পোজিং স্টিক থেকে কম্পোজ-করা ম্যাটার নামিয়ে রাখেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর ওপরেই ম্যাটারে বা সজ্জিত অক্ষরে রোলারের সাহায্যে কালি মাখিয়ে ম্যাটার বা লিখিত-বস্তু সংশোধনের জন্য প্রুফ তোলার ব্যবস্থা করা হয়। সম্পন্ন ছাপাখানায় অবশ্য কদাচিৎ প্রুফ-প্রেস বলে স্বতন্ত্র মেশিন থাকে।
এই মলিন পরিবেশের তৃতীয় অংশ মেশিন ঘর। যে মেশিনের ফর্মায় বা টাইপ ফ্রেমে বিন্যস্ত-অক্ষর এঁটে মেশিনে লাগিয়ে মেশিনের ওপরের অংশের শিল্ডে কালি দিয়ে মেশিনের প্যাডে এক হাতে একটি একটি করে কাগজ দিয়ে ও অপর হাত দিয়ে তুলে চলে মুদ্রণের কাজ। ফলে সাধারণভাবে বিগত শতকের সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত এই পরিবেশের অচ্ছেদ্য অংশ ছিল মেশিন চলার অকাতর ও লাগাতার শব্দ। মেশিনেরই বা কত রকমসকম! মেশিন-অনুযায়ী শব্দের রকমফের।—
এই ছিল পুরোনো একটি লেটারপ্রেসের পরিচিত চিত্র।
প্রেসপাড়ায় অনেকের অবশ্য মেশিনের বালাই ছিল না। তাঁরা শুধু কম্পোজের কাজই করতেন। তারপর গ্যালিতে করে ম্যাটার বয়ে নিয়ে গিয়ে নিকটবর্তী অন্য-কারও মেশিনে ছেপে নেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল ছাপাখানাপাড়ার কর্মপদ্ধতির অঙ্গ!
উনিশ শতকের শেষভাগে, নয়ের দশকে যান্ত্রিক টাইপ সেটিং পদ্ধতি শুরু হয়েছিল। টাইপসেটিং-এর জন্য কী-বোর্ড ব্যবহার করা যেত। এসব হট মেটাল টাইপ সেটিং-লাইনোটাইপ, মনোটাইপ কম্পোজিশন কাস্টার সিস্টেম, হট লিড টাইপসেটিং ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত ছিল। বাংলা মুদ্রণের ক্ষেত্রে এসব ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়েছিল আরও পরে, ১৯৩৫ সাল নাগাদ। পরবর্তী প্রায় অর্ধশতককাল সেসব ব্যবস্থা আধুনিক ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। কিন্তু এই আবিষ্কার ও আধুনিক নানাবিধ অক্ষরবিন্যাস পদ্ধতির ক্রমঃপ্রচলন সত্ত্বেও আমাদের দেশীয় মুদ্রণশিল্পে স্বতন্ত্র ও নড়নশীল টাইপসমূহ (হাতে সাজিয়ে চলমান কম্পোজ পদ্ধতি)-ই লেটারপ্রেসে বিগত শতকের শেষ পর্যন্ত একাধিপত্য করে এসেছে।
ছাপার মেশিনই বা কত কিসিমের! পায়ে-ঠেলা ট্রেডল কিংবা প্যাড-প্রেসিং, হ্যান্ড-প্রেসিং মেশিন, পরে এসবের জায়গায় নানা- ধরনের ফ্ল্যাট মেশিন।
কিন্তু সাধারণ দৃশ্য ছিল এই যে, মেশিন যেমনই হোক না কেন কম্পোজিং-এর ব্যবস্থা ছিল সর্বত্র প্রায় একই রকম। হাতে নড়নশীল টাইপ সাজিয়ে, পেজ-অনুযায়ী মেকাপ করে ম্যাটার তৈরি করাটাই ছিল দস্তুর। সুতরাং অক্ষরবিন্যাসকারী অর্থাৎ কম্পোজিটরের পেশাও প্রায় দুই শতাব্দী জুড়ে ছিল আমাদের সমাজের পরিচিত পেশাসমূহের অনবচ্ছিন্ন অংশ।
এটা সেই সময়ের কথা যে-সময় আমাদের কাকা-বাবা- জ্যাঠামশাইদের বোকামি-ভরা এমন একটা জীবন ছিল, যে-জীবনে কাঁঠাল কাঠের বড়ো বড়ো পিঁড়িতে বসে খুড়তুতো-জ্যেঠতুতো-পিসতুতো-দেশতুতো-বন্ধুতুতো ইত্যাদি নানা বয়সের জনা-পনেরো ভাইবোনের বড়ো কাঁসা বা ভরণের বগি থালায় ডাল আর গোল গোল আলুভাজা দিয়ে সাপটে ভাত খাওয়ার সুযোগ ছিল। আর গরমে হাঁপাতে হাঁপাতে পরিবেশনরত মা-বড়োমা-মেজোমা-কাকিমার চোখ এড়িয়ে দেদার খুনসুটি করে হাসিতে গড়িয়ে পড়ার অবকাশ ছিল।"
........................................
লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর
এক বিষাদান্ত পরম্পরা
অনন্ত জানা
....................................
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment