লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

'হস্ত-প্রক্ষালন' কথাটি ব্যবহার করতেন প্রবীণতম কম্পোজিটার সুবলবাবু। টিফিন আওয়ার শুরু হওয়ার মুখে ছোকরা ইঙ্কম্যান অনিল দাস কম্পোজ ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠতেন—'চলুন দাদাসকল, বাবুসকল, কাকাসকল—মধ্যাহ্নকালীন পিণ্ডপাতের আগে আমরা হস্ত-প্রক্ষালনে যাই।' ঐ মলিন পরিবেশ, কালিমালিপ্ত দেওয়াল, প্রতপ্ত টিনের চালার জ্বলুনি—সবকিছু অগ্রাহ্য করে হাসির হররা উঠত ঘরটির মধ্যে।

সত্যি কথা বলতে গেলে আহার-পর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল এই 'হস্ত-প্রক্ষালন'! কেননা, সিসার টাইপ তৈরি করা হতো বিমিশ্রিত সংকর ধাতু দিয়ে। সুবলবাবুর কথায়—যার মধ্যে সাধারণভাবে থাকত ৫৪-৮৬ শতাংশ সিসা, ১১-২৮ শতাংশ অ্যান্টিমনি এবং ৩-১৮ শতাংশ টিন। অতুল সুর জানিয়েছেন যে, সিসার সঙ্গে অল্প পরিমাণ বিসমাথ নামক ধাতুও মেশানো হতো। (বাংলা মুদ্রণের দুশো বছর) রাসায়নিকভাবে এর সাথে আর্সেনিক ও অ্যান্টিমনির মিল আছে। অ্যান্টিমনি সিসার মতো নরম এবং ছুরির সাহায্যে কর্তনযোগ্য ধাতুকে শক্ত করে, টিনও ধাতুকে শক্ত করে, অ্যান্টিমনির ভঙ্গুরতা নিয়ন্ত্রণ করে। এই বস্তুগুলোর কোনোটাই মানব-শরীরের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক নয়।

সিসা মানবদেহের পক্ষে তো বিষ। নাগাড়ে সিসা মানবদেহে প্রবেশ করলে সিসার বিষক্রিয়ায় শিশুদের তো বটেই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরও নানাবিধ শারীরিক অসুবিধা দেখা দেওয়াটা অনিবার্য। লেটারপ্রেসের ছাপার কালিও মানবদেহের পক্ষে নিরাপদ নয়।

প্রথমদিকে ভুষোর সঙ্গে তেল মিশিয়ে ছাপার কালি তৈরি করা হতো। ভুষোর মান-অনুযায়ী কালির গুণাগুণ বা স্থায়িত্ব নির্ভর করত। (অতুল সুর : প্রাগুক্ত, ১৩৮৫)

ক্রমেই ছাপার কালি রাসায়নিক যৌগের এক জটিল মিশ্রণে পরিণত হয়। কালির দ্রাবক ভিত্তি—তা সে তেলই হোক বা জল—এটি তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য তার মধ্যে প্রাথমিকভাবে রাসায়নিকের ব্যবহার অনিবার্য। যেমন অক্সিডেশন, পলিমারাইজেশন, অতিবেগুনি নিরাময় (প্রতিকার বা দোষমুক্তি), ফিজিক্যাল প্রক্রিয়া—বাষ্পীভবন, শোষণ ইত্যাদি।

সাধারণভাবে লিথোগ্রাফিক, স্ক্রিন এবং লেটারপ্রেসে ব্যবহৃত কালি টোনারজাতীয় নয়, পেস্ট কালি। অবশ্য এর কোনোটিই মানব-স্বাস্থ্যবান্ধব নয়।

টাইপ-সেটার বা কম্পোজিটারা ছাড়াও তাই একদা যে ট্রেডল মেশিন ব্যবহৃত হতো সেখানে ইঙ্ক-শিল্ডে যাঁরা কালি লাগাতেন তাঁরা এবং মেশিনম্যানদেরও প্রচুর কালি মাখতে হতো। হাতে তোলা কাঁচা গ্যালি-প্রুফ সংশোধন যাঁদের করতে হতো সেই প্রুফ রিডারদের তো কনুই পর্যন্ত কালি লাগাটা ছিল অনিবার্য। ফলে খাবার আগে হাত ধুতে লাগত অনেকটা সময়। সাবান লাগানোর আগে কেরোসিন তেল দিয়ে হাত ধুয়ে নিলে সিসার কষ ও কালির আঠালো ভাবটা তাড়াতাড়ি দূর হতো। কিন্তু তখনও রন্ধন ও অন্যান্য কাজে কেরোসিন ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অন্তর্ভুক্ত সামগ্রী। এবং বেশিরভাগ সময় কেরোসিনের দুর্মূল্যতা ও কখনও কখনও দুর্লভতার কারণে কেরোসিন জুটত কম। কেননা, গ্যালি ও মেকাপ প্রুফ তোলার পর এবং ছাপা শেষ হবার পর বার বার ম্যাটার ধোয়ার কাজে ব্রাশ ও কেরোসিনের ব্যবহার ছিল আবশ্যিক। ট্রেডল মেশিনের ইঙ্ক-শিল্ড পরিষ্কার করার জন্য স্বল্পপরিমাণ কেরোসিন ও বাতিল-ছাপা ব্যবহৃত সস্তার নিউজপ্রিন্ট লাগত। সুতরাং কেরোসিনের ইচ্ছেমতো ব্যবহার স্বল্পবিত্তের লেটারপ্রেসের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া খাবার আগে কেরোসিন দিয়ে হাত ধোয়ার পর হাজার সাবান লাগালেও হাত থেকে কেরোসিনের গন্ধ তাড়ানো ছিল কঠিন কাজ। সুতরাং হাত থেকে সিসার কষ তোলার জন্য যৎসামান্য কেরোসিন প্রয়োগ করা হতো।

হস্ত-প্রক্ষালনের প্রবক্তা সুবলবাবু স্বয়ং বলতেন—'কেরোসিনের গন্ধ দিয়ে ভাত খাওয়ার থেকে সিসা খাওয়া উত্তম!'

কিন্তু সিসা যতই উত্তম হোক তিনি তো কাউকে সিসা-হাত নিয়ে খাবার খেতে দেবেন না! সুতরাং খিদের মুখে অর্ধ-ঘণ্টাব্যাপী 'হস্ত প্রক্ষালন!'

বাবাদের পত্রিকার প্রেসঘরের পিছন দিকে ছিল বিশাল এক চৌবাচ্চা। চৌবাচ্চা ভর্তি কর্পোরেশনের কলের জল, নিচের দিকে এক-হাত অন্তর অন্তর সমান্তরালে সারি দিয়ে কল লাগানো। চৌবাচ্চার ওপরে গোল গোল বল সাবান, একটা নারকেল মালা ভর্তি সোডা-জাতীয় ক্ষারের গুঁড়ো, নারকেলের ছোবা, কয়েকটা থান ইট ইত্যাদি রক্ষিত থাকত। কম্পোজিটারদের হাত-ভর্তি সিসার তৈরি টাইপের কালো কষ ধোওয়াটা একটা পর্ব ছিল বটে। চৌবাচ্চার ওপরে কয়েকটি থান ইটও শোভা পেত। সকলেই হাতে কাপড়কাচা সাবান, সোডা মাখিয়ে নারকেলের ছোবা দিয়ে ঘষে ঘেষে হাত ধুতেন, আঙুলের ডগাগুলো পাশের দেওয়ালে আর সেই থান ইটে ঘষতে হতো। হ্রস্ব-নখের ভিতরটা পরিষ্কার করতে সময় যেত অনেকটা।

বেশিরভাগ কর্মীই আসতেন দক্ষিণের শহরতলি এলাকা থেকে, আমাদের কুঠিডাঙার মতো দূরত্ব থেকে, আরও একটু দূর থেকে যাঁরা আসতেন তাঁদের বাড়ি থেকে বেরোতে হতো বেশ সকাল সকাল, ফলে অনেকেই খিদের চোটে ধৈর্য ধরতে পারতেন না, তাড়াহুড়ো করে ভালোভাবে হাত না-ধুয়েই ভাতে হাত দেবার জন্য ব্যস্ত হলেও সুবলবাবু দাঁড়িয়ে থেকে ভালোভাবে হাত ধুইয়েই ছাড়তেন। তখন লেটারপ্রেসের সেই পরিবেশের সঙ্গে এই অযাচিত স্বনির্বাচিত অভিভাবকত্বও ছিল মানানসই।

বিকালবেলা বা সন্ধের মুখে কম্পোজিটরদের টিফিন খাওয়াটাও রীতিমতো দর্শনীয় ব্যাপার ছিল। টিফিন বলতে ছিল মুড়ি বা মাখা। মুড়ি মানে ঠোঙায় মুড়ি, চিড়েভাজা, খোসা-ওড়ানো চিনাবাদাম, দু-চারটি ছোলা-মটর দিয়ে ঠোঙার মধ্যেই নাড়া দেওয়া। খোসা-ওড়ানো বাদাম মানে লাল খোসাওয়ালা ভাজা বাদাম দুই তালুর মধ্যে নিয়ে ঘষা দিয়ে খোসাগুলো ছাড়িয়ে ফুঁ-দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সাদা বাদামগুলো মুড়ির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া (প্রিন্টিংপ্রেসের চেহারা-চরিত্র আমূল বদলে গেলেও এই খাবারটা এখনও কলকাতার সর্বত্র এবং প্রেসপাড়াতেও দিব্যি টিকে আছে)। প্রেসের সঙ্গে মুড়ির দোকানের তেমন-কোনো অব্যবহিত-সম্পর্ক না-থাকলেও আমাদের কুঠিডাঙা জায়গাটা কলকাতার কাছাকাছি হওয়ায় এখানে প্রেসের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবাঙালি পরিচালিত এমন মুড়ির দোকানও দেখা দিয়েছিল। অক্ষরশিল্পীরা কখনও হাতে করে মুড়ি মুখে তুলতেন না। কম্পোজ করতে করতে বাঁ-হাতে মুড়ির ঠোঙা ধরে মুখগহ্বরে মুড়ি ঢেলে দিতেন। চা খেতেন নিজেদের অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে বা মাটির ভাঁড়ে।

বাবাদের কাগজের প্রেসে সারাদিনে অন্যসময় কম্পোজিটররা যতবার চা খেতেন সঙ্গের বিস্কুটটি হাত দিয়ে না ধরে টাটকা অর্থাৎ অব্যবহৃত নিউজপ্রিন্টের টুকরো দিয়ে জড়িয়ে ধরতেন। পূর্বোক্ত শ্রীজগন্নাথ হোটেলের পাশের চা-দোকানি ষষ্ঠী বাড়ুজ্যে এমন নিউজপ্রিন্টের গ্লাভসওয়ালা লেড়ো-বিস্কুট এবং চা সকলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেতেন। সে এক মজার দৃশ্য। বিস্কুটে যত কামড় পড়ছে বিস্কুট তত ছোটো হচ্ছে, হাত দিয়ে না ধরে বিস্কুটের শেষ টুকরোটা পর্যন্ত খাওয়ার চ্যালেঞ্জ তত বাড়ছে। এ-বিষয়েও ছোকরা কম্পোজিটরদের ট্রেনিং দিতেন সুবলবাবু—কী করে কাগজের আলগা মোড়কের মধ্যে আটকে থাকা ক্ষুদ্রতম বিস্কুটের অবশেষটি পর্যন্ত সিসাক্ত আঙুল দিয়ে না-ছুঁয়ে মুখের ভেতরে চালান করতে হয়!

অধিকাংশ মাঝারি মাপের লেটার প্রিন্টিংপ্রেসের সঙ্গে নিজেদের বা তাদের প্রতিবেশী বাইন্ডিংখানা ছিল। বাবাদের কাগজের প্রেসে কম্পোজিটর ও মেশিনচালকরা ছাড়াও বাইন্ডার হিসেবে পরিচিত বিতরণ ও প্যাকেজিং বিভাগের তিন কর্মীও সকলের সঙ্গে মধ্যাহ্নাহার করতেন আর একসঙ্গে টিফিন খেতেন। সুবলবাবুর ঠেলায় তাদেরও সকলের সঙ্গে 'হস্ত-প্রক্ষালন'-এ অংশগ্রহণ করতে হতো। কেননা, প্রত্যেকদিন ওঁদের কয়েক কেজি আঠা ব্যবহার করতে হতো। সাধারণভাবে ময়দা, অ্যারারুট, ভাতের জাউ অথবা আটা জ্বাল দিয়ে ঐ আঠা তৈরি হতো। এবং তার সঙ্গে মেশানো হতো তুঁতে। হালকা নীল রঙের তুঁতে বা কপার সালফেট আসলে এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ। এটা ছত্রাকনাশক, আঠাখেকো কীট প্রতিরোধক এবং মানুষের শরীরের পক্ষেও বিষাক্ত। সুতরাং হেড কম্পোজিটর সুবলবাবুর এলাকার মধ্যে এঁরাও শাসিত হতেন।

লেটারপ্রেসের সঙ্গে স্বাস্থ্যহীনতা ও কর্মপরিবেশের বিষয়টা পুরোপুরি বিজড়িত ছিল। কালিমালিপ্ত দেওয়াল ও স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে, প্রায় আলোবাতাসহীন ঘরে জিনিসপত্রে ঠাসাঠাসি পরিবেশ। আসলে অধিকাংশ প্রেসই ছিল কোনো বসতবাড়ির নিচের তলায় প্রায়ান্ধকার ঘরে। ব্যতিক্রম থাকলেও ভাঙা বা ফাটা মেঝে, কাগজপত্রে, টাইপকেস, গ্যালিতে, সস্তার আসবাবের প্রতিবেশই ছিল লেটারপ্রেসের ট্রেডমার্ক।
........................................
লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর
এক বিষাদান্ত পরম্পরা

অনন্ত জানা
....................................
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা

সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।