সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত মিহির সেনগুপ্তের স্মৃতিগদ্য 'সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম' পড়ে নিজেদের পেজে মতামত জানিয়েছেন Journal of a Bookworm. আমরা তাঁদের অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
....................................................................................................................................

#পাঠ_প্রতিক্রিয়া- ৩৯/২০২৪

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম
লেখক - মিহির সেনগুপ্ত
প্রকাশক - সুপ্রকাশ প্রকাশনী
মূল্য - ৫০০ টাকা।। 

বছরের ৩৯ নম্বর বই সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, বইটি মূলত উজান থেকে ভাটির দিকে ছুটে আসা এক মানুষের স্মৃতিচারণ। লেখক তপন রায় চৌধুরীর 'অচেনা পিতৃভূমি, অজানা আত্মজন' নামক প্রবন্ধটি এই বইকে কেন্দ্র করে, সে বইতে তিনি বলছেন '...রচনাটি উপন্যাস নয়, লেখকের জন্মভূমি এবং পাশেই শ্বশুরালয়ের গ্রাম কীর্তিপাশায় অবকাশ যাপনের কাহিনী। আর সেই প্রসঙ্গে ওখানকার মানুষের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ছবি।' মিহির সেনগুপ্ত একসময় দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে। বরিশালের কীর্তিপাশা গ্রামে তার শ্বশুরালয় আবার সেই গ্রামের পাশের গ্রামে তার পৈত্রিক বাড়ি। এই কাহিনি দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে তার দেশে ফেরার।

✨✨ পটভূমি—

এ চিরকালীন আখ্যান বাংলা ভাষায় এক ও অদ্বিতীয়।  স্মৃতিকথার শুরুতে রূপসার ধারে গড়ে ওঠা হোটেল মালিক মোকছেদের সাথে পরিচয়। যার হোটেল বয়েরা যুদ্ধশিশু আর যার রাঁধুনি আর সে নিজে মিলে যুদ্ধের সময় ঘটায় দুঃসাহসিক কাজ। মোকছেদ এর মুর্শেদ হুলার হাটের ফকির সাহেব। মোকছেদ বলেন, “মোরগা কারবার দিল দরিয়ার তুফানে নাচনের কারবার।” যাত্রা পথে হুলার হাট মোকছেদ নিজে চরণদার হয়ে তার গুরুর কাছে নিয়ে চলেন সেনগুপ্ত পরিবারকে। সেই ফকির সাহেব অপার স্নেহে কাছে টেনে নেন লেখককে। 
লেখকের স্মৃতিগদ্যে ধরা পড়েছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পনেরো-বিশ বছর পরের বরিশাল জেলার একটি গ্রামাঞ্চল। বর্ধিষ্ণু হিন্দুরা অনেক আগেই সীমান্ত পার হয়ে 'হিন্দুস্তানে' চলে গেছেন। সমশ্রেণীর মুসলমানরা নতুন সুযোগের সন্ধানে গেছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং আরও দূরদেশে-- দুবাই, সৌদি, মার্কিন মুলুকে। দুঃস্থ ব্রাত্যজন পড়ে আছেন। পরস্পরকে শ্যাখ বা মালাউন বলে সহর্ষ বিদ্রূপ করতে তাঁদের বাধে না, আবার তারাই চাঁদা তুলে দুর্গাপূজা করেন, পূজা প্যাণ্ডেলের চাল তৈরীর জন্য টিন আনেন মসজিদ থেকে। মালাউন দেওর 'হিন্দুস্তান' চলে গেলে তার শ্যাখ বড়ভাই বাঁচবে না বলে মুসলমান ভাবী চোখের জল ফেলেন। খলিল ঠাহুর ভোগ রাঁধেন। সঙ্গে বলতে পারেন, "খাইতে চাও খাও, না খাও তো খালপাড়ে গিয়া হোগা মারাও"। পুজোর রাতে জারি গান, সারি গান-এর আসর বসে। জেগে থাকে চিরকাল 'খেদানি খেয়ে ভাতের গ্রাস তোলা' বাঙালির সত্য পরিচয়।
ঘাটের থেকে তাকে আপ্যায়ন করতে এসেছেন তার আত্মজনেরা। এসব আত্মজনেদের সাথে বাঁধা আছে তার শৈশব। তাদের মধ্যে আছেন, সৈয়দ আলি চাচা, নসু(নাসির), ভাবী সহ অনেকেই থাকেন।
দেখা যায় ভাবী এবং নিবারণকাকার সাথে বাপ বেটির সম্পর্ক। মুঈনউদ্দিন চাচা আর নিবারণকাকার উঠানে রোজ সকালে তারা সকালে কাককে খুদ খাওয়ায়। মুঈনউদ্দিন চাচার কাক মোছলমান আর নিবারণ কাকার কাক হিন্দু।
রাতে যখন বৃষ্টি নামে তখন মন্দিরের পূজা-অঙ্গন কাদায় ভরে ওঠে। অঙ্গন ঢাকার জন্য বাজারের হরিসভায় টিন আনতে পাঠানো হয়। কিন্তু হরিসভার কত্তারা টিন দেয় না, সেখান থেকে জানানো হয় "ওহানে টিন দেওন যাইবে না। ওহামে শ্যাখ, হিন্দু বেয়াকে একলগে খাওনদাওন করে, নাচে কোদে, ওরা মোরা ভালো ঠেহি না।" এর মাঝে জামাই মেম্বারে টিন জোগাড় করে দেয় মীরাকাডি মসজিদের জন্য বরাদ্দকৃত। সেই টিন নিয়ে আসেন ছবুর মোল্লা।
সপ্তমীর সকালে মঞ্চে হাজির হয় কার্তিক যার গানের গলা অসাধারণ। এরপর সন্ধ্যায় এসে হাজির হয় ছোমাদ বয়াতি। রায়বাড়ি তার বাপের বাড়ি। এককালের রায় কর্তাকে সে বাপ ডেকেছিলো। ছোমাদ বয়াতি আসার পর লেখক উল্লাস করে বলে ওঠেন, "ছোমেদ বয়াতি এসেছে, এ সংবাদ আমার কাছে এক অপূর্ব সমাচারের মতো শিহরণ জাগায়। ছোটোবেলার সেই ছোমেদভাই। যে কোনো অবস্থায়, যে-কোনো পরিস্থিতিতে, মুখে মুখে যে শব্দবন্ধ, কবিতা, কথা তৈরি করে যাদুর ভেল্কি দেখাতে পারে, যে মানুষকে চূড়ান্ত নৈরাশ থেকে, বিবর্ণ জীবনযাত্রার কুৎসিত একঘেয়েমি থেকে, ধ্বংসের বিভীষিকা বা দারিদ্র্যের ক্ষীয়মাণতা থেকে মানবিক হৃদয়বৃত্তের বলয়ে স্থাপনা করতে পারে, কিংবা যে তার নিজস্ব মণ্ডলের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির রক্তচক্ষু এবং অত্যাচারকে তুচ্ছ করে, ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির প্রসারণে নিজেকে অতন্দ্র রাখতে পারে, সেই ছোমেদ ভাই এসেছে।"
ছোমাদ জারি সারি, কীর্তন, রয়ানি, পরণকথা, কথকতায় জারি সারি, কীর্তন, রয়ানি, পরণকথা, কথকতায় কথায় দক্ষ শিল্পী। ছোমাদের আগমন এই বইয়ের একটা বাঁক হিসেবে ধরা যেতে পারে। সেই বাঁক লেখকের এই স্মৃতিকথাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন অন্যদিকে। তার স্মৃতিকথাকে করে তুলেছেন আরো প্রাঞ্জল, আরো বৈচিত্র্যময়। সপ্তমীর রাতে ছোমাদ জারি গানের আসর বসায়, এই আসরে ছোমাদ যেসব গান বা কথা বলে ওঠেন তা তৎক্ষনাৎ মুখে মুখে বানানো গান। কথাকে নিয়ে যেদিকে গড়ানো যায় সেইদিকে গড়িয়ে যান কথক তার সাধ্যমতো। ছোমাদ কথকথায় নিয়ে আসেন বাস্তবের মানুষজনকে। নিয়ে আসেন বেঁচে থাকা মানুষকজনের কথা। তার গান মন্দির অঙ্গনে তৈরি করে অন্য আবহ। 

✴️✴️ পাঠ প্রতিক্রিয়া—

"দিন যায়, শোক হয় পাতলা। তারপর কবরের মাটিতে দূর্বা ঘাস গজায়। যত গজায় ততই শোক হয় স্বচ্ছ। এক সময় সে শোক হয় স্মৃতি।।"
শোকের স্মৃতি খুঁজে বলা চমকপ্রদ এক আখ্যান।।
মিহির সেনগুপ্ত এর লেখা প্রথমবার পড়লাম আর মুগ্ধ হলাম।। এই স্মৃতিকথা, এই উজান থেকে ভাটিতে ফেরার গল্প বহু বহুদিন মনে থাকবে।। 
মিহির সেনগুপ্তের 'সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম' বাংলা সাহিত্যে আরেকটি অনন্য সংযোজন বলা যায়। এই স্মৃতি কথায় বাংলার বাউল ফকিরদের কথা উঠে এসেছে। তাদের ছুঁয়ে গিয়েছেন লেখক। তারপরে দেখা যায় ব্রাত্য মানুষগুলো যাদের হিন্দু সমাজ এবং মুসলিম সমাজ নীচে দাবিয়ে রেখেছে তাদের মিলেমিশে থাকার চিত্র। বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবাষ্প আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গিয়েছে এই নির্মল গল্প তার চেয়ে বহুগুণ উপরের কথা বলেন। আঞ্চলিক এই ভাষা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে হয়তো ধাক্কা খাবেন। তবে এই বইয়ের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে আঞ্চলিক ভাষার সহজ সাবলীল প্রয়োগে। সর্বোপরি লেখক যে সমাজ এবং যেসব মানুষদের কথা তুলে ধরেছেন তাদের নিয়ে এমন মমতায় আর কেউ কিছু লিখেছেন কিনা জানি না। ছোমাদের মতো মানুষ আজ মন খুলে মন্দির প্রাঙ্গণে কথা বলার, গানি ঝাঁপি খোলার আগে দশবার ভাববেন। তার চেয়ে বড় কথা তারা তো হারিয়েই গিয়েছে প্রায়। আমরা আমাদের সমাজের একটা অংশকে সচেতন ভাবেই অগ্রাহ্য করেছি। ভাষাগত জটিলতাটুকু যদি বাদ দেওয়া যেত, সত্যিই বলতে জটিল নয় একটু সময় নিয়ে ধৈর্য্য ধরে পড়লে সমস্যা হবে না, এই স্মৃতিকথাটি আরো পাঁচটি স্মৃতিকথা থেকে গুণে মানে এবং গুরুত্বে খুবই আলাদা।।


Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।