অভিমানভূম।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।।

বেঞ্চ বাজিয়ে গান মানেই, ক্লাসের ফাঁকে হল্লা চরমে। আর লাস্ট বেঞ্চ হলে তো কথাই নেই! সেই ডানদিকের লাস্ট বেঞ্চ বাঁধা ছিল তাদের জন্য। দুটো ছেলে। লাস্ট বেঞ্চ বলেই, অনেকটা বড়ো হয়ে যেত তাদের কাছে ক্লাসরুম। ঘণ্টা বাজলেও তাড়াহুড়ো নেই। পায়ে পায়ে ওড়া ধুলো খানিকটা থিতিয়ে গেলে, স্কুল ছুটির পর কিংবা শনি-রবির বিকেলে ছোট্ট সবুজ মফস্বলের পাশ দিয়ে বাঁক নেওয়া গঙ্গার ধার। জংলা মতো জায়গাটা পেরিয়ে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া একটা সিমেন্টের চাতালে বসলেই, পায়ের সামনে জল। ছলাৎ ছলাৎ শব্দের আবহে 'আমার ভিতর ও বাহিরে'। কখনও কখনও বয়স খানিকটা বেড়ে যাওয়ার পরেও গঙ্গার উপরের বাতিল কাঠের জেটিতে নাদান ছেলেমানুষি একগাদা। চিৎকার করে ‘সুন রি সখী' কিংবা ‘মেঘ বলেছে’ হয়তো। বলতোও মেঘ। হঠাৎ বৃষ্টি দিলে কোনোদিন, কাক ভেজা ঝুপ্পুস। তারপরে আরও খানিকটা পাড় ভেঙে এগিয়ে এলে নদী, টান পড়ে কখন সেই বন্ধু-বৃত্তের ব্যাসার্ধে। ছেলেটাও আজগুবি হয় আরও। খুব মনখারাপ থাকলে আচমকা চলে যায় দক্ষিণেশ্বর বা গঙ্গা পেরিয়ে বেলুড়।
এই বিশাল জোয়ার-ভাটা নদী আর তার পলি-কাদার গন্ধ নিয়ে বেড়ে উঠেছে যে, সেই তার কাছে পাথুরে মানভূমের এই রোগাসোগা পাঁজরের হাড় বের করা নদী ভালো লাগতে পারে কি? কিন্তু এতই আশ্চর্য এখানকার নদীদের রং আর রূপ, এমনিতেই বসে পড়তে ইচ্ছা হয় পাথরের গা ঘেঁষে। এদিকে বুকের ভিতর লুকানো ভীষণ চাঁদের পাহাড়'। আনমনা ছেলেটা প্রথম যেদিন নদী দেখতে গেল, পাথুরে উপত্যকা দেখে বলে উঠেছিল, 'আরে, এতো আমাদের ভেরি ওন রিখটারসভেল্ড!'
কাজের জন্য প্রায়ই ঘুরতে হয় এদিক-ওদিক। কথা বলতে হয় অনেকের সঙ্গে। যত মিশছি, বুঝতে পারছি, মূলত জল, জঙ্গল, মাটি— এই হলো ভরসা এখানকার মানুষদের। প্রায় সমস্ত উৎসবও এইসব চির বহমান প্রকৃতিকে ঘিরেই। নদীর উপরেও সারি সারি পাথর। জলের উপর থাকলেও, পাথরে শ্যাওলা নেই একটুও। পাথরের মধ্যেই সবুজ ঘাসের দল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কোথাও কোথাও। তার নিচ দিয়ে কলকল চলে যাচ্ছে জল। মনে হয়, এই অসীম প্রকৃতি থেকেই হয়তো ‘সহাবস্থান' শব্দটা এভাবে শিরায়- উপশিরায় ঢুকে গেছে এখানকার মানুষজনের মধ্যে।

‘নিজের’ এই শব্দটাকে ঘিরে যে একটা বিভ্রম থাকে, সেটা কেমন কেটে যাচ্ছে এখানে আসার পর থেকেই। এত এত প্রাচীন সব সংস্কৃতির হদিশ মিলছে, যেগুলো হয়তো না-জানাই থেকে যেত এখানে আসা না হলে। ঠিক কবে থেকে যে এই মাকুরি মেলার শুরু, সে তথ্য যদিও কারোর কাছেই পাওয়া গেল না। লোক উৎসবের বৈশিষ্ট্যই বোধহয় এটা। আজীবন বহতা নদীর মতো ভেসে চলা শুধু। দেখি, উৎসব ঘিরে বিশাল মেলা। কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও উৎসাহে যে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি, সে বোঝা যাচ্ছে থিকথিকে ভিড় দেখেই। মেলা বসেছে নদীর পাড়ে যেমন, তেমনই নদীর মধ্যেকার চরেও। বেশ কয়েকজন পুলিশের বড়কর্তাকেও দেখা গেল হাজির ভিড় সামলাতে। দূর-দূরান্ত থেকে গাড়ি বোঝাই হয়ে আসছে মানুষজন। মেলার প্রকৃতি যদিও মানভূমেরই অন্য পাঁচটা মেলার থেকে বিশেষ আলাদা কিছু নয়। প্রচুর খাবার দোকান, মেয়েদের সস্তা কাচের চুড়ি, কানের দুল, ঘরের কাজের জিনিস এমনই সব। কেনাকাটি সেরে নদীর চরেই বালির উপরে বসে পড়েছে মানুষ। যতক্ষণ দিনের আলো, ততক্ষণই উৎসব।
.
.
.
.
অভিমানভূম
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায় 

অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।