অভিমানভূম।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।।

"টিকিট চলে এল। দু’দিন পরে রাতের ট্রেন। এগারোটা পাঁচের চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার। নামতে হবে বলরামপুর স্টেশন। সেখান থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। কী ব্যবস্থা থাকবে, সেটা তখনও জানা নেই। কিন্তু নিজের মতো করে গুছিয়ে নিলাম খাতা, পেন। একটা রেকর্ডারও দেওয়া হল না; নতুন ছেলে কী করতে কী করবে! ক্যাননের একটা ছোট ওয়ান শট ক্যামেরা জোগাড় করা গিয়েছিল কোনোভাবে। বারবার বলে দেওয়া হয়েছিল, স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা না বলে ক্যামেরা যেন বের না করা হয় একদমই। 

হিম-কুয়াশায় আবছা চারপাশ। কুয়াশা রেললাইনের উপরেও। মোটা চাদরে শরীর ঢাকা মানুষের যাতায়াত প্ল্যাটফর্মের উপর। একটা রাতের যাত্রাপথ কতটা দূরে এনে দেয় আমাদের? ভাবতে ভাবতেই হুইসল দিয়ে এঁকেবেঁকে দূরের পাহাড়টার নিচে হারিয়ে যেতে থাকে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার। কে জানতো, পরবর্তীতে এতবার এই ট্রেনে চড়তে হবে যে, মজা করে ছড়াও কাটবে একজন, “তোমার বাড়ি কি রেলগাড়ি?”

প্রথম যাত্রায় হাওড়া থেকে রাতের ট্রেনে সাইড লোয়ার বার্থ। এই বার্থটাই সব থেকে প্রিয়ও বটে। রাতের বেলা তেমন কিছুই বোঝা না গেলেও, খড়গপুর পেরিয়ে যাওয়ার পরেই কনকনে হাওয়া আসতে থাকে একটা জানালা দিয়ে। কাচ ফেলে দিতে হয় অগত্যা। তাকিয়ে থাকি রাতের অন্ধকার আর তার মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠা সাদাকালো জোনাকির মতো দূরের আলোগুলোর দিকে। যেন এগিয়ে চলা সবকিছু ছেড়ে। ভেসে যাওয়া অন্ধকারের হাওয়ায়। কোথায়? শুয়ে শুয়েই ভাবি, খেয়েছে! একেই কি বৈরাগ্য-টৈরাগ্য বলে নাকি? 

গরীব তথা বেকার ছেলের মনখারাপের বাতিক থাকতে আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু, মনখারাপ হচ্ছে। ট্রেনের ধকধক শব্দে মনে হচ্ছে পিছনে ফেলে দিচ্ছি এতদিনের মনে পড়া মুখ, মুখের উপর উঠে পড়া চুল, অটোয় পাশে বসে আঙুলের ভিতর ধরে থাকা আঙুল আর কোনোদিন ছেড়ে না যাওয়ার মতো শপথ। মিথ্যে। গায়ে লাগছে না কোনও কিছুই খুব একটা আর। শুধু মনে হচ্ছে, কোনোদিন আর ফিরে না গেলেই তো হয়! কী হয়, সাদা-কালো মিথ্যে কথার শহরে কখনোই যদি ফিরে না যাই আর? তার থেকে তো এই ভেসে পড়াই ভালো। নতুন গন্তব্য ভালো। নতুন দেখা ভালো।

তখনও কে জানতো, এইসব গন্তব্যই আজীবনের মতো সঙ্গী হয়ে থেকে যাবে চারপাশে আমার!

কখন যে চোখটা লেগে গেছে, বোঝা যায়নি। যখন ঘুম ভাঙল, ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে গেছে ছয়ের ঘর। পুরুলিয়া স্টেশনে ট্রেন থামবে সাতটা নাগাদ। আরও মিনিট চল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ পরে নামতে হবে বলরামপুর। জানালা দিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ সবুজ। যদিও সবুজের রংটা ক্ষয়াটে। তাতে একটু লালচে আভাও চোখে পড়ছে বেশ। মাটির উপর জমে আছে কুয়াশা। কুয়াশা জমে আছে জলের উপরেও। মাথায় বা সাইকেলের ক্যারিয়ারে খড় নিয়ে কোথায় চলেছে লোকজন। অনেকের সঙ্গেই চাষের জিনিসপত্রও। কুয়াশায় চলে বেড়াচ্ছে গরুর পাল বা ছাগলের সারি। মাটি ভেজা থাকায় ধুলো উঠছে না তাদের ক্ষুরে।"

আসছে....

অভিমানভূম
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।