অভিমানভূম।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।।

কালো একটা চাদর ঢেকে ফেলছে ক্রমশ আকাশ। তার কালো ছায়ায় আরও গাঢ় হয়ে উঠছে কালচে সবুজ। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে চোখ মেলছে জংলি লতা। মাথা তুলে যেন বুলি ফোটা বাচ্চাদের মতো শোনাতে চাইছে কিসসা, যেন কোনো দূরের দেশের। বৃষ্টি আসছে খুব। খুব বারিষ! খলবল করতে করতে ছুটছে কোথায় ছেলেপুলের দল? ‘বাঁধের ধারে। মাছ উঠবে তো!' শিলাই মাঠের হরিমণ্ডপে আড্ডা খানিক প্রৌঢ় বা মধ্যবয়স্কদের। তাদের আশেপাশে, সামনে বা পিছনের দিগন্তে সবুজ খুব বেশি এখন। সবুজ খুব ঘাস। গাছের পাতা। রুখা জমিতে কদিনের জন্য যেন আদরের প্রলেপ।

পুরুলিয়া টাউন থেকে কাজ সেরে ফেরার পথে দেখা হয় এইসব কিছু কিছু অল্প চেনা জানা মুখের সঙ্গে। ডাক আসে অধিকারের টানে। কী সেই অধিকারের নাম? জানা নেই। ভালবাসা কি এতই সহজে পাওয়া যায়? কিংবা নিছক স্নেহ বা বন্ধুত্ব? দু'গ্লাস চায়ের পরে উঠতেই হয় অগত্যা। খুব বৃষ্টি চলে এলে আটকে পড়তে হবে। সঙ্গে অফিসের কাগজপত্র রয়েছে বেশ কিছু। আর এই গ্রাম থেকে ভোরবেলা টাউনে গিয়ে সারাদিনের কাজ সেরে ফেরা তারপর আরও পঞ্চান্ন কিলোমিটার ব্যাপারটা একটু ক্লান্তিকরও বটে। ‘চললো?'

‘উঠি এবার!' এখন আর 'বাড়ি যাব' বলা হয় না। বলি, 'ঘর যাব।' বলি আবার আসবো পরে একদিন।

ফিরতেই ফিরতেই মেঘ কালো হয়ে আসে আরও। যেদিকটা কালো হয়ে এসেছে খুব, সেদিকটাই বাঁকুড়া-দুর্গাপুর হয়ে শহর আমার। আবার সেই টানাপোড়েন চিরন্তন। করে যাওয়া হবে ঘরে? হাওয়া আসে ধানজমির উপর দিয়ে। মাঠের কাজ সেরে কাদা শরীরে উঠে আসছে পুরুষ-মহিলার দল। মুখে হাসি। কারণ আকাশের মেঘ। এটুকুই তো সম্বল ! তাদের হেঁটে যাওয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকি খানিকক্ষণ। ওই পথেই? ওই পথেই কি? ‘কান্ট্রি রোডস্ টেক মি হোম'... হঠাৎ করে কোথা থেকে ডেনভার এসে গুনগুন করে যান মাথার ভিতর... টু দ্য প্লেস আই বিলং...' কিন্তু আমি? কোথায়?

অথচ গান আসার কথা ছিল শালতলে বেলা ডুবিল'। ডুবলই তো! এই কালচে হয়ে আসা মনমরা বিকেল, জোলো হাওয়া... খুব বৃষ্টি হলে ভেসে যাওয়া কাসাই... জলে থইথই ভরে ওঠা বাঁধ... এমন সময়েই তো ডুবে যায় চোখ হঠাৎ পথচলতি কারোর হাসি বা কানেকানে ফিসফাস দেখতে দেখতে। সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের থেকে মুখ ফিরিয়ে তরুণী বলে ফেলে ভীষণ অভিমানে, ‘মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে!' বৃষ্টি আসার আগেই তার চোখে শ্রাবণ অকাল। কোন ছাতায় বাধ মানবে এই ধারা? পশ্চিমের বাতাস আর দক্ষিণের মেঘ ছুঁয়েই তো গান আসার কথা ছিল এমন সময়ে... 'সোনার ছাতা ভাঙিল, সোনার ছাতা ভাঙিল, সোনার ছাতা ভাঙিল রে...'

চোখ হঠাৎ পথচলতি কারোর হাসি বা কানেকানে ফিসফাস দেখতে দেখতে। সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের থেকে মুখ ফিরিয়ে তরুণী বলে ফেলে ভীষণ অভিমানে, ‘মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে!' বৃষ্টি আসার আগেই তার চোখে শ্রাবণ অকাল। কোন ছাতায় বাধ মানবে এই ধারা? পশ্চিমের বাতাস আর দক্ষিণের মেঘ ছুঁয়েই তো গান আসার কথা ছিল এমন সময়ে... 'সোনার ছাতা ভাঙিল, সোনার ছাতা ভাঙিল, সোনার ছাতা ভাঙিল রে...'
.
.
.
.
আসছে...
.
অভিমানভূম
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
.
প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায় 
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল 
.
সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।