অভিমানভূম।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।।

একটা মাঠ জ্বলে যাচ্ছে রোদ্দুরে। রোদে পুড়ে হলদে হয়ে গেছে মাঠের ঘাস। মাঠের মাঝে মাঝে খেজুর বা তালগাছ। তার পিছনে, গরম হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে ওঠার মতো দূরে রুক্ষ পলাশ গাছ খান কয়েক। পলাশের সঙ্গে শাল। সোনাঝুরিও। মাঠের পাশে আলের ধারে একটা অশ্বত্থ গাছ ঝাঁকড়া। তার তলায় এই আকাশ ফাটা রোদেও ছায়ার প্রলেপ কেমন। সেখানে বসে একটা আদুল গায়ের ছেলে... না, বাঁশি বাজাচ্ছে না। ফোন ঘাঁটছে গাছে হেলান দিয়ে। ‘বাজার’ তার সর্বস্ব নিয়ে হইহই করে ঢুকে পড়ছে প্রান্তিক মানভূমেরও কোণায় কোণায়।
এই ঠাঠা পোড়া দুপুরে বাইরেই বা কেন আদুল গায়ের ছেলে? গাছের ছায়া থেকে একটু দূরত্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার বাইরে বেরোনোর উপলক্ষ্যেরা। উপলক্ষ্যদের রুগ্ন সাদা-কালো-ঘিয়ে-খয়েরি শরীরের মধ্যে উজ্জ্বল শুধু গলার টুংটুং ঘন্টিটা। তাদের সারা গায়ে ছোপ ছোপ দাগ। আসলে রোল নম্বরের মতো দাগিয়ে দেওয়া, যাতে গুলিয়ে না যায় এই চারপেয়ে শাবকদের আসল সংসারের প্রমাণ।
মোবাইল ঘাঁটতে থাকা ছেলের পাশ দিয়ে এগিয়ে আসে এতক্ষণ ধরে মাঠে কাজ করে চলা কয়েকটা শরীর। এই গরমে খোলা মাঠের রোদ্দুরে অসুস্থ হয়ে পড়া আশ্চর্য নয়। অথচ এদের হবে না কিছু। কিছু হয় না এদের। সকালেই তাল বা খেজুরের তাড়ি খেয়ে মাঠে নেমে গেলে রোদের বড়মামারও সাধ্যি নেই নাকাল করে আর! আর এদের হাঁটা-চলাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে মুখ লুকিয়ে কোথাও নাগাড়ে ডেকেই যাচ্ছে পাখি একটা। ট্টি ট্টি ট্টি।
এইসব দৃশ্যের থেকে দূরত্বে দাঁড়িয়ে, ঘটমান এই বর্তমান রেকর্ড করতে থাকে একটা সস্তার ক্যামেরা। দূরত্ব বজায় রাখতে হয়, কারণ এই আশ্চর্য নীরবতা ভেঙে দিতে ইচ্ছা করে না কিছুতেই। কিছু দূরত্ব মানতে শেখা জরুরিও, শিখিয়ে যায় একলা থাকার সময়। কোথা থেকে বাচ্চা একটা ছেলে ওই রোদের মধ্যে দিয়েই ছুটে এসে আলের পাশ দিয়ে নেমে গিয়ে হারিয়ে যায় জল শুকিয়ে আসা একটা পুকুরের ওই পাড়ে। সেখানে খড়ে বাঁধা নিচু চালের কুঁড়ে একটা, খিদের সময় যার কথা মনে পড়া চিরন্তন। সেখানে ফিরে এসে আঁচলের ছায়ায় দাঁড়ালেই, এনামেলের থালায় ভাতের সঙ্গে স্নেহ ছড়ায় সেদ্ধ মেটে আলু। সঙ্গে নুন, কাঁচালঙ্কার সওগাত। খিদের মুখে সেই ভাতের গন্ধ পেলেই এনামেলের থালার ভাঙা কোণে সূর্য ঠিকরিয়ে চকচক করে ওঠে চোখ। খিদের মতোই সহজ সেই ছেলের হাত ডুবে যায় এক থালা বাষ্পে।
পুরুলিয়া-কলকাতা আর কলকাতা-পুরুলিয়া যাতায়াতের মধ্যে এই তীব্র গরমের দিনগুলো কেমন হলুদ রঙের মায়ার মতো ভিড় করে আসে বিকেলের জানালার কাছে। পুরুলিয়া যাওয়ার জন্য সকালের ‘রূপসী বাংলা’ আর বিকেলের ‘পুরুলিয়া এক্সপ্রেস’ বিলকুল না-পসন্দ। রাতের চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ছাড়া বরং মায়াবী ভীষণ দুপুরের রাঁচি-হাওড়া ইন্টারসিটিটা। ঝাড়গ্রাম থেকে টাটানগর হয়ে বরাভূম পেরিয়ে ঢোকে সেটা পুরুলিয়ায়। ছোটার পথে পার হয় বিশাল ছোটনাগপুর মালভূমির একটা রেঞ্জ। দুপুরের রোদটা পড়ে এলেই, বাইরের গনগনে গরম হাওয়ার তেজটাও পড়ে আসে কেমন। তার সঙ্গেই গা ধুয়ে পাড়া বেড়াতে বের হওয়া মেয়েদের মতো জেগে ওঠে অদ্ভুত সুন্দর নামের একেকটা স্টেশন। নামের থেকেও বেশি সুন্দর হয়তো গাছপালা ঘেরা তার নির্জনতা। স্নিগ্ধতাও ছিমছাম ভীষণ। লাল-সাদা দেয়াল। গাছের পাতায় ভরে আছে স্টেশনের লালচে বেঞ্চিগুলোও। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে শালপাতা, অশথপাতা। সেই খয়েরি-সবুজ পাতাদের ব্যাকড্রপে আবছা ধূসর একটা পাহাড়। পাহাড়ের পিছন দিয়ে অন্ধকার নেমে এলে ঝুপুস, ট্রেন থেকেও নামার সময় হয়ে আসে। এবং স্টেশনে বাহন নিয়ে হাজির মলয়দা। লাস্ট বাস তো বিকেল চারটে বাজলেই পগারপার! এত সন্ধেয় ভরসা অগত্যা তিনিই। দেখতে পেয়ে চায়ের ভাঁড় ফেলে দূর থেকে একগাল হাসি। ‘দমে গরমটা পড়্যেছে হে!’
.
.
.
.
.
আসছে... 

অভিমানভূম
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।