নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘নৈশ অপেরা’ পড়ে মতামত জানিয়েছেন তারা। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
………………………………………..
।।।নৈশ অপেরা।।।

অতি প্রিয়জনরা হারিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে ছায়া হয়ে‌। সবটাই কি ভ্রম? একসাথে এতগুলো মানুষের ভ্রম হয়? হতে পারে? এ যেন এক অলিখিত ভবিতব্য। একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে কতবার সাঁতরে ফিরেছি। কয়েকবার মনে হয়েছে, আর না। এই রহস্যকে চাদরে ঢেকে রাখাই ভালো। আবার মনে হয়েছে, কেন হলো? কি উদ্দেশ্য ছিল? কি অপরাধ ছিল তাদের? নিষ্পাপ প্রাণ যখন হারিয়ে যায় টাউনের বুক চিঁড়ে, কিংবা পরিবার থেকে তখনের পরিস্থিতি কেমন হয়? মানুষগুলো ভেঙে পড়ে। শুধুই ভেঙে পড়ে। মন থেকে, বাহ্যিকভাবেও। তারপরেও শ্বাস নেয়। কোমায় থাকার মতো বেঁচে থাকে একটা সময়। অপেক্ষা থাকে। কিন্তু কার? অতি প্রিয় মানুষের ফিরে আসার? তারা কি ফিরতে পারে? সেই অজানা জলঘোলাকে কেন্দ্র করেই এইবার সাজানো হয়েছে শাক্যজিৎ এর 'নৈশ অপেরা'। রহস্যপোনাসের আড়ালে ভ'য়, শ'ঙ্কা, আবেগ, উ'ৎকন্ঠার একটা ছোট্ট প্যাকেজ। সাথে আছে অমাদের অতি পরিচিত তনয়া।

সত্যি বলতে পশ্চিমবঙ্গের লেখা বলতে যে নামখানা আমার চোখে ভাসে তিনি সত্যান্বেষী। সত্যান্বেষীর রিপ্লেসমেন্ট এক যুগ পরেও কেউ নিতে পারেননি ঠিকই তবে তার দুঃখ ঘুচাতে নতুন একখানা নাম হানা দিয়েছিল বইয়ের পাতায়। আমি তাকে বলি 'লেডি সত্যান্বেষী'। তনয়া ভট্টাচার্য; আমাদের গল্পের মূল নায়িকা। কিংবা পার্শ্বচরিত্র থেকেও মূল হয়ে উঠা একখানা চরিত্র। পেশায় একজন সাংবাদিক। যার দেখা মিলেছিল 'শেষ মৃ'ত পাখি'তে। লেখকের গল্প বুননে যেখানে হারিয়েছিলাম। হারিয়েছিলাম দার্জিলিং এ। এখানে হারিয়েছি বিপরীতে। প্রকৃতির মাঝে মাথা চেড়ে উঠা ঝাড়খণ্ডের এক পরিত্যক্ত টাউনের ভাঙাচোরা ভবনগুলোর আড়ালে মৃ'ত কিংবা জীবিত মানুষগুলোর গল্প শুনতে। পরিবারের সবচেয়ে কাছের সদস্যকে হারিয়ে এক রহস্যে বুঁদ হয়ে যাবার গল্প। না চাইতেও আমাদের লেডি সত্যান্বেষী কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়ে এই অমিমাংসিত অভিযানে। সেই সাথে আমিও। 

শাক্যজিৎ বাবুর লেখার হাতের তারিফে পঞ্চমুখ হবার আগে বলা ভালো ওনার লেখার ধরণটা আসলে কি নিয়ে? রহস্যপোনাসে রহস্যের ছিটেফোঁটা কি শুধু রহস্যের একটা মোড়ক দিয়েই শেষ হয়ে যায়? গথিক ধারণার বাইরেও লেখক দেখিয়েছেন ভিন্ন কিছু। ঝাড়খন্ডের সেই টাউনকে পাতায় না তুলে তিনি তুলে এনেছেন পর্দায়। পুরোটা সময় পড়াকালীন মনে হবে যেন লেখক পাঠককে ঝাড়খন্ডেই তুলে নিয়ে গেছেন কিংবা সেখানে বসেই সবটা সাজিয়েছেন। ঠিক যেন শিল্পীর কালিতে ফুটিয়ে তোলা শিল্পের মতো। পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন প্রতিটি দিককে অথচ একটা সূক্ষ্ম শিহরণ ঢেলে দিয়েছেন কাহিনীতে। পুরনো রহস্য ঘাটতে গেলে যেমন কিছু না কিছু বাদ পড়ে যায় তেমন বাদ পড়ে গেছে তনয়ার কাছেও। কিন্তু পাঠক হিসেবে বারবার সেই লিংকগুলোর সুতো বাঁধতে ইচ্ছে করেছে। প্রথম পর্ব এই সুতো বাঁধার আগের ধাপ হলেও দ্বিতীয় ধাপে লেখক ক্লাইমেক্সে টেনেছেন একেকটা স্তর। ধুম করে রহস্য উন্মোচন না করে সময় দিয়েছেন পুরো বিষয়টাকে। পুরো দিকটাই তিনি এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন পাঠক প্রতিটি চরিত্রের মানসিক টানাপোড়েনের সঙ্গী হতে পারে শেষ অব্দি। সেই টানাপোড়েনে একবার মনে হয়েছে রহস্য কম, ভৌতিক আবহ বেশি। আবার মনে হয়েছে, পিছনে কিছু ছুটে গেল না তো? 

তবে যদি পাঠক হিসেবে জিজ্ঞেস করেন 'নৈশ অপেরা' কি 'শেষ মৃ'ত পাখি'র আসল উত্তরসূরী হতে পেরেছে কিনা? তাহলে আমি বলব অনেকাংশে পেরেছে, কিছু ক্ষেত্রে আরো বেড়ে গেছে। লেখকের বর্ণনার ধরণ, শব্দচয়ন এবং স্তর ভেদে রহস্য উন্মোচনের সাথে স্টোরি টেলিং অবশ্যই আগের থেকেও বেশ ভালো হয়েছে। বিশেষত অনুভূতি এবং টানাপোড়েনগুলো। বইখানা শেষ করতে আমার লেগেছে সবে একদিন। একটু তাড়াহুড়োতে পড়েছি তবে একটানা পড়তে গিয়ে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। লেখকের কাব্যিক টোনে লেখার ধরণটা হয়ত অনেকের মনে ধরবে আবার অনেকেই ধীরে পড়ে রস আস্বাদনে সার্থক হবেন বলেই আশা করি। চরিত্রগুলোর সাথে খুব সহজে মিশে যাওয়ার যে প্রবণতা সেটা হয়ত লেখকের গল্পবুননের সার্থকতা। যদিও সব রহস্যের কোনো যথার্থ কারণ থাকতে নেই, কিছু রহস্য হয়ত না খুঁজলেও চলে। আশা করা যায় এই সিরিজের তৃতীয় কোনো পর্ব এসে আমাদের চমকে দিবে। তনয়া ভট্টাচার্যের হয়ত দেখা মিলবে আবার নতুন কোনো অঞ্চলে। সেই সাথে বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই স্ট্রেঞ্জার কে এই বইখানা পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্য। 

▪️সুপ্রকাশের প্রোডাকশন আমাকে মনে করায় বাতিঘর চট্টগ্রামের কথা। ডাস্ট কভার টু বাঁধাই সবটাই মিল আছে। তবে প্রথমে হাতে নিয়ে মনে হয়েছিল বাইন্ডিং কিছুটা নড়বড়ে। তবে পড়ার সময় মনে হলো ওদের বাঁধাইয়ের ধরণটাই হয়ত এমন। আর প্রচ্ছদটা বেশ মনোরম। গল্পের সাথে এলিমেন্টের মিল মিলবে পড়ার সময়। 

বই : নৈশ অপেরা 
লেখক : শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য 
প্রকাশনী : সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ রূপি

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।