নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'নৈশ অপেরা' পড়ে মতামত জানিয়েছেন জয়দীপ মুখার্জি। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.......................................................
।।পাঠ প্রতিক্রিয়া।।
নৈশ অপেরা। সুপ্রকাশ।
মূল্য - ৫৪০ টাকা।

'জীবনে বহুবার এমন হয়,অফিসার।সব রহস্যের উত্তর মেলেনা। আমি সেগুলোকে নিয়ে বাঁচতে শিখেছি।'

রেবেকা কেস। অমীমাংসিত রহস্য। 'শেষ মৃত পাখির' পর আমাদের প্রিয় রহস্য কাহিনির লেখক Sakyajit Bhattacharya আবার তনয়া চরিত্রটিকে পাঠক সমাজে এনেছেন এক অমীমাংসিত রহস্য উন্মোচন করতে। বর্ষায় ভেজা দার্জিলিং এর পর এবারের পটভূমি— অক্টোবর মাসের ঝাড়খণ্ডের গঞ্জ। পাঠক আন্দাজ করতে পারে জায়গাটির প্রকৃত নাম— ম্যাকলাক্সিগঞ্জ।

লোকে বলে, এখানে পাহাড়ী ভূতের দল বাসা বেঁধে আছে অনেকদিন হয়ে গেল। রাত হলে তাদের ফিসফিসানি, চাপা গলায় অট্টহাসি অথবা অকস্মাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার আওয়াজ পাওয়া যায়। এই টাউন ক্রমশঃ ভেঙে পড়ছে। এখানে হেমন্ত আসে রিক্ত সন্ন্যাসীর আগমন বার্তার মতো। গাছেরা পাতা ঝরিয়ে কঙ্কাল অবয়ব আকাশের বুকে মেলে। আছে ডেগাডেগি নদী। নদীর উপর ব্রিজ থেকে দেখা যায় আদীবাসী কিশোর মোষ তাড়ায়। এছাড়া আছে  রহস্যময় এক জলাভূমি। জঙ্গলের ভেতর নির্জন এক চার্চ। 

এখানকার মানুষ বেশিরভাগ ভাঙাচোরা। অতীতের ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করে বেঁচে আছেন। এই টাউনে বারবারা ব্রাউনের হোম স্টে-তে থাকতে আসে তনয়া। নিজের জীবনের একাকীত্ব ও বিষাদ যাপন ছেড়ে জড়িয়ে পড়ে ব্রাউনদের বাড়ির কয়েক দশক পুরোনো এক শিশুর অপহরণ অথবা হারিয়ে যাওয়ার রহস্য উন্মোচন করতে। বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই শিশু মাঝে মাঝে সেখানে দেখা দেয়। পাঠক বুঝতে পারে না এ এক অলৌকিক কাহিনী নাকি রহস্য কাহিনি অথবা কিছুই নয়। হয়তো শুধুমাত্র বেদনার কথা বলে এই উপন্যাস।

অতীত খুঁড়তে গিয়ে বারবারা, অবিনাশ যাদব, এডওয়ার্ড, মনীষা, অ্যারন, রকির বাবা, ডলোরেস চরিত্রগুলোর সামনে যে সত্য তুলে ধরেন আমাদের সাংবাদিক গোয়েন্দা তনয়া তার প্রভাব হয় সুদূর প্রসারী। পুরোনো পাপ যখন স্মৃতির সঙ্গে হুড়মুড় করে জল স্তম্ভের মতো ভেঙে পড়ে তাদের মাথায়, পরিত্রাণ পায় না কেউ। শেষ বয়সে এসে এতো বেদনা নেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই চরিত্রগুলোর। মনে হয় এই রহস্য উন্মোচন না হলেই ভালো হতো। কিন্তু তবুও পাঠক জানতে চায়— ঠিক কী হয়েছিল। পাঠক জানতে চায়, অপরাধের মোটিভ। প্রতিশোধের আগুন জ্বলে কাকে কাকে পুড়িয়ে ছাই করে। শব্দের পর শব্দের নুড়িপাথর গড়িয়ে গিয়ে ভুলে যাওয়া ব্রাউন পরিবারের ইতিহাস; অভিশপ্ত কাহিনী তুলে আনতে সক্ষম হয় তনয়া। পাঠকের বিহ্বলতা কাটে না পাঠ শেষে।

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের গদ্য অত্যন্ত আধুনিক ও স্মার্ট।তার কাব্যিক ভাষায় মুগ্ধ হওয়া পাঠকের ভবিতব্য। গঞ্জের প্রকৃতি ও পরিবেশ যেভাবে লেখক তার কল্পনার চোখে ফুটিয়ে তুলেছেন, যেভাবে রহস্য কাহিনির আবহ সৃষ্টি করেছেন তাতে 'নৈশ অপেরা' শুধুমাত্র রহস্য কাহিনি নয় প্রকৃত অর্থে মহৎ সাহিত্য কর্ম তথা আর্ট হয়ে উঠেছে। শুধুই রহস্যের সমাধানকে পাখির চোখ না করে, একজন ডিটেকটিভ এর আত্মায় কী ঘটে তার সম্যক উপলব্ধি ঘটে পাঠকের। তবে শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের গদ্য অখন্ড মনোযোগ দাবি করে‌। বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভিন্ন চরিত্রের মুখ থেকে আমরা ঘটনা প্রবাহ শুনি। অতীত থেকে বর্তমানে পেন্ডুলামের মতো ঘোরে এই কাহিনীর ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার। গল্প কখনো ২০২২ থেকে চকিতে চল্লিশ বছর পিছিয়ে যায় আবার পরের পর্বেই ২০২৫ এ গিয়ে রহস্যের জালে আবদ্ধ করে পাঠককে।  কখনো কখনো ঠাহর করতে বেশ অসুবিধা হবে যে— কথক কে অথবা কোন টাইমলাইনে গল্প বলা হচ্ছে। কিন্তু লেখকের মুন্সীয়ানা এতোটাই অটুট থাকে রহস্যের জট ছাড়াতে যে পাঠক বুঁদ হয়ে থাকবে আগাগোড়া।

আখ্যানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যি তনয়া যখন আবিষ্কার করে, পাঠক মনে মনে বাহবা দেয় লেখককে। এই নিস্তরঙ্গ টাউন ক্রমশঃ পাঠককে তার নিজের মধ্যে পাকাপাকি বাসিন্দা করে নেয়। রহস্য উন্মোচন ঘটে কিন্তু তবুও পাঠক মনে মনে ঘুরপাক খায় জোহার হালে। হা হা বাতাস, শাল সেগুন প্রহরী হয়ে জেগে থাকে আর পাঠককে মনে করায় মৃত সমাধিদের কাহিনী।

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।