নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'নৈশ অপেরা' পড়ে মতামত জানিয়েছেন সায়ন সরকার। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.......................................................
Year 2025 Book 43
#2025bookreview
নৈশ অপেরা 
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য 
সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য ₹৫৪০

ঘাটশিলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মুসাবনী বলে একটা ছোট্ট শহর আছে। মুসাবনী তে আমি বার দুয়েক গেছি কারণ আমার এক আত্মীয় সেখানে থাকেন। অদ্ভুত শহর এই মুসাবনী। ব্রিটিশ জমানায় খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছিল বলে শহরটি অর্থনৈতিকভাবে এক দারুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল, হিন্দুস্তান কপারসের অফিস থেকে শুরু করে তাদের কোয়ার্টার এবং প্রচুর বিত্তশালী লোকেদের বাস ছিল এই মুসাবনীতে। তারপর যা হয় অর্থাৎ খনিজ পদার্থ ফুরিয়ে এল, হিন্দুস্তান কপার এখান থেকে অফিস গুটিয়ে চলে গেল এবং আমি প্রথম যখন এই শহরে যাই, অর্থাৎ ওই ২০২০ নাগাদ তখন এই শহরটা একটা ভুতুড়ে শহর। গোটা শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা বাংলো, ফাঁকা সরকারি কোয়ার্টার, কিছু স্কুল (সরকারি এবং মিশনারি) যেগুলো কোন মতে ধুঁকতে ধুঁকতে চলছে এবং সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার যেকোনো শহরের যেটা প্রাণ বায়ু অর্থাৎ যুবসমাজ বলে সেরকম কিছুই শহরে দেখতে পাওয়া যায় না। শহরের শিক্ষিত যুবসমাজ সরকারি চাকরি পেলে পাড়ি দিয়েছে রাঁচি কিংবা জামশেদপুর আর আমার আত্মীয়র মত প্রচুর ছেলেমেয়ে চলে গেছে ব্যাঙ্গালোর, পুনে কিংবা ইউকে তে। 

রাজ্যটা একই, কিন্তু শহর টা আলাদা, যে শহর আমাদের চেনা এক টুরিস্ট ডেস্টিনেশন, সেই একই রকম ভুতুড়ে একটা শহরকে কেন্দ্র করে লেখক শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য লিখেছেন তনয়া ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় উপন্যাস নৈশ অপেরা। এই উপন্যাস ভৌতিক হতে পারে, হতে পারে এক রহস্য কাহিনী অথবা এসব কিছু না হয়ে শুধুই হতে পারে এক শহরের কিছু মানুষের যন্ত্রণার ইতিহাস। 

আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমাদেরই পাড়ার এক পরিবারের সাথে আমাদের ভীষণ হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল। সেই পরিবারের একটিমাত্র মেয়ে হঠাৎ করে একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেনা। অনেক খোঁজ নেওয়া হয়, অনেক সম্ভাবনার কথা উঠে আসে কিন্তু দিনের শেষে এই মেয়েটি আর কোনদিনও বাড়ি ফেরেনি। এ এক আলাদা ঘটনা, যা নিয়ে পরে কোনদিন আলোচনা করব, কিন্তু মোদ্দা কথা হল এই মেয়েটি হারিয়ে যাওয়ার যে অমীমাংসিত রহস্য এবং বেদনা, তা এই পরিবারটিকে শেষ করে দেয়। মেয়েটির বাবা আগেই মারা গেছিল, মেয়েটির মা বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন এবং মেয়েটির একমাত্র ভাই পরের দিকে কেমন পাগল পাগল হয়ে গেছিল। 

ঠিক এই একই থিম লেখক ব্যবহার করেছেন এই উপন্যাসটিতে। ঝাড়খণ্ডের এই ভৌতিক টাউনটির এক পরিবারের এক ছোট্ট শিশু হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজার পরেও, অনেক কিছু করার পরেও সেই শিশুটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ঘটনাটি ঘটার প্রায় ৩০ বছর পর সেই শহরে আসেন তনয়া। আস্তে আস্তে পরিচিত হতে থাকেন এই মৃত শহরের কিছু মানুষ অথবা ভুতেদের সাথে। পাঠক হিসেবেও আমরা পরিচিত হতে থাকি বারবারা ব্রাউন, এডওয়ার্ড, মনীষা, অ্যারন, জেনিফার, অবিনাশ যাদব প্রভৃতি চরিত্রদের সাথে। পেঁয়াজের খোসার মতো আমাদের সামনে পরতে পরতে উন্মোচিত হতে থাকে এক ভৌতিক রহস্য কাহিনী। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই ৩০ বছরের পুরনো অমীমাংসিত রহস্যের সাথে জড়িয়ে পড়েন তনয়া। জানতে পারা যায় হারিয়ে যাওয়া এই শহরে নতুন কিছু নয়। এই শহরে আগেও কিছু মানুষ হারিয়ে গেছে, কিন্তু আগেই বলেছিলাম এই শহর ভৌতিক। তাই হারিয়ে যাওয়ার পরেও ছোট্ট ক্রিসকে ৩০ বছর ধরে এক রহস্যময় জলাভূমির ওপর ঘুরতে দেখেন তার পিসি বারবারা। আরো একটি মেয়ে যে হারিয়ে গেছিল সেই অ্যাগনেসকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে দেখতে পায় বিভিন্ন মানুষ। লেখকের লেখনীতে তৈরি হয় অদ্ভুত কিছু দৃশ্য কল্প। একটি মেয়ে যাকে তনয়া জিপসিদের রাজকন্যা বলতো সে শহরের বিভিন্ন জায়গায় সাদা রঙের একটি জামা আর মাথায় একটি মুকুট পড়েঘুরে বেড়াত, রেভারেন্ড গরম্যান কে আমরা প্রথম দৃশ্য দেখতে পাই একটি জঙ্গলের মধ্যে খালি গায়ে একটি ফোনের রিসিভারকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন। একটি মৃত শহর, ভেঙে পড়া সাহেবী আমলের বাংলো, জঙ্গলের মধ্যে এক ভাঙ্গা রহস্যময় চার্চ এবং হারিয়ে যাওয়া কিছু মানুষ, সব মিলিয়ে লেখক গল্পের প্রথম ভাগে পাঠককে বিভ্রান্ত করে দেবেন যে এ আদৌ কোন রহস্য গল্প না ভৌতিক কাহিনী। গল্পের প্রথম ভাগ যেখানে শেষ হচ্ছে অর্থাৎ রহস্য এবং প্লট যেখানে ফাইনালি এস্টাবলিশ করছেন লেখক, সেই জায়গায় এসে রয়েছে গল্পের এমন এক অভিঘাত যে পাঠক হিসেবে আমি কিছুক্ষণ বই বন্ধ করে বসে ছিলাম। 

এরপর শুরু হয় গল্পের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ যেখানে রহস্য উন্মোচনের পালা। বিশেষ এক কারনে তনয়াকে এই রহস্য অমীমাংসিত রেখেই সেই গঞ্জ থেকে ফিরে আসতে হয়। রহস্যের অভিঘাত এমনই ছিল অথবা অ্যারন এর ভাষায় এই রহস্য এতটাই অভিশপ্ত যে ফিরে আসার পর তনয়ার জীবন ওলট-পালট হয়ে যায়, কিন্তু তিন বছর পর তনয়াকে আবার ফিরতে হয় এই গঞ্জে একটি বিশেষ ঘটনার জন্য। দ্বিতীয় ভাগে সেই ফিরে আসা এবং রহস্য উদঘাটন। পাঠক হিসেবে এরকম বহুস্তরীয় রহস্য উপন্যাস বাংলায় আমি অন্তত আগে পড়িনি। 

অপরাধ একটা ছিল না, ছিল বেশ কয়েকটা অপরাধ যা ঘটেছিল বেশ কিছু বছর ধরে। যেটা তনয়ার আগে অবিনাশ যাদব ধরতে পারেননি তা হল এই অপরাধগুলোর মধ্যে কিছু কানেকশন ছিল। তনয়ার মাধ্যমে রহস্যের আংশিক উন্মোচন সম্ভব হয় এবং বাকিটা পাঠক হিসেবে আমরা জানতে পারলেও তা তনয়ার কাছে অজানাই থেকে যায়। 

রহস্য গল্পের আঙ্গিকে শেষ মৃত পাখিকে আমি কিছু জায়গায় এগিয়ে রাখবো, আবার ভাষার ব্যবহার, নন লিনিয়ার ন্যারেটিভ এবং গল্পের ক্লাইম্যাক্সের মালটি লেয়ার্ড এপ্রচ্ এর দিক থেকে আমি আবার এই বইটিকে এগিয়ে রাখব। উপন্যাস যখন শুরু হচ্ছে তখন পাঠক হিসেবে টুকরো টুকরো কিছু ঘটনা, কিছু র‍্যাণ্ডম চরিত্র আমাদেরকে ছুঁড়ে দেন লেখক, যা প্রথম পঞ্চাশ থেকে একশো পাতা আমাকে সামান্য হলেও বিভ্রান্ত করেছিল, পরে বুঝেছিলাম তা লেখক করেছেন ইচ্ছাকৃতভাবে। তিনি চেয়েছিলেন এই গল্পের জটিলতা, গঞ্জের পরিবেশ এবং জীবিত ও ভৌতিক চরিত্রগুলো পাঠককে প্রথম থেকে বিভ্রান্ত করুক, যে বিভ্রান্তি ধরে পাঠক পৌঁছে যাবেন এমন এক উপসংহারে যেখানে পৌঁছে পাঠকেরও তনয়ার মত মনে হবে এই রহস্যের উন্মোচন হওয়া কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল। 

এই গল্পে শাক্যজিৎ এর আগের বেশ কিছু গল্পের ছোঁয়া আমি ফিরে ফিরে পেয়েছি। রহস্যময় জলার ধারে একটি ভাঙ্গা অ্যাম্বাসেডর আমাকে বারবার মনে করাচ্ছিল "ডেরেক বসে আছে এখানে' এর কথা আবার একটি ভাঙ্গা বাড়িকে যেভাবে আগলে ধরে বছরের পর বছর পড়ে আছেন বারবারা তাতে আমার মনে পড়ছিল "অলৌকিক বাগান" এর কথা। একটি মানুষ যে চলে গেছে অথবা হারিয়ে গেছে এবং তাকে কেন্দ্র করে একটি পরিবারের কিছু মানুষের বছরের পর বছর ধরে অপরাধ-বোধে ভোগা, মনে করায় ডেরেক বা "একানড়ে"। হয়তো এই উপন্যাস শেষ মৃত পাখি না বীরেশ্বর সামন্তর মত অতটা রাজনৈতিক নয়, তবুও ঘুরেফিরে আসে অ্যাংলো বনাম মূলনিবাসীদের সামাজিক সমীকরণ এবং গল্পে খুব প্রচ্ছন্নভাবে চলতে থাকা তৎকালীন বিহার এবং বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাজনৈতিক উত্থান পতন। এই রাজনৈতিক উত্থান পতনের সমীকরণে গল্পের একটি চরিত্র শেষের দিকে বিশাল একটি ভূমিকা পালন করে তাও বোঝা যায়।

কিছু কিছু সাহিত্যকর্ম মনের মধ্যে এমন এক অভিঘাত তৈরি করে যার ফলে বেশ কিছুদিন অন্য কিছু আর পড়া সম্ভব হয় না। নৈশ অপেরা সেরকমই এক সাহিত্যকর্ম এবং শেষ মৃত পাখির যোগ্য উত্তরসূরী।

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।