নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'নৈশ অপেরা' পড়ে মতামত জানিয়েছেন রাজর্ষি মনফকির। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.........................................................
নৈশ অপেরা
লেখক : শাক্যজিত ভট্টাচার্য 
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০/-

☘️পাঠানুভব ও কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতি☘️

"প্রতিশোধ লওয়া আমার,আমি প্রতিফল দিব। তাহাদের পা পিছলাইয়া পড়িবে; তাহাদের বিপদকাল আসন্ন এবং তাহাদের সর্বনাশ ছুটিয়া আসিতেছে।" —Deuteronomy 32:35

শাক্যজিত ভট্টাচার্য'র লেখা উপন্যাস আমি আগে পড়িনি। আমি ওনার " অনুষ্ঠান প্রচারে..." আর কিছু ওয়েব্জিনে লেখা নন ফিকশন পড়েছি। ৮-৯ দশকের বৌদ্ধিক জীবনচরিত নিয়ে সেই সব লেখা পড়ে আমার ভালো লেগেছিল। এক অবসন্ন, অন্ধকারচ্ছন্ন আচ্ছনতায় জারানো সেই লেখা ভুলে যাওয়া ভাবনার সুরতহাল করত। কিন্তু," শেষ মৃত পাখি" আর " ডেরেক" সংগ্রহ করার পরেও সেই উপন্যাস গুলি আমার পড়া হয়নি।  কোন কারণ নেই, এমনিতেই পড়া হয়নি।
কিন্তু যখন " নৈশ অপেরা" র ব্লার্ব পড়লাম,নিশ্চিত ছিলাম এই উপন্যাস টি আমাকে পড়তে হবে।  কারণ অকুস্থল এবং তা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অনুভব।

"নৈশ অপেরা" র অকুস্থল হল ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। কাহিনীতে যদিও গঞ্জ বলেই মূলত লেখা। কিন্তু পারিপার্শ্বিক গ্রাম বা নদীর নামে তা স্পষ্ট।  ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নিয়ে আম বাঙালীর পরিচয় বোধহয় লালাবাবুর "একটু উষ্ণতার জন্য" র পাঠ দিয়ে। হয়তো অন্যরাও লিখেছেন,আমার জানা নেই।  বাঙালীর ঝাড়খণ্ড ভ্রমণের একটা দিন বরাদ্দ থাকত এই জায়গার জন্য। এবং সেটা লালাবাবুর লেখার জন্য আর কোন বিখ্যাত বাঙালী বুদ্ধিজীবী বাসস্থান ক্রয় করেছিলেন সেই জন্য। কিন্তু এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জ এ দেখার কী আছে, সেই প্রশ্ন উঠলেই এখন অনেকেই বলেন, সেরকম কিছু নেই, কিছু শাল মহুয়ার বন, পরিত্যক্ত পোড়ো বাড়ি আর কিছু নেই।  বাংলা ফেবুর বিখ্যাত ভ্রমণবিদ গৌতম বিন্দুর ভাষায় কিস্যু নেই। ব্যাপারটা ভুল নয়,জায়গাটার স্থানিক দর্শন মাহাত্ম্য বলে সেইরকম কিছুই নেই।
কিন্তু, এই ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ নিয়েই পূর্বেই লিখেছিলাম, আমার কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে। আজ থেকে বহু বছর আগে ৮ এর দশকের শেষদিকে, আমার পাড়ায় একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার আসে।  তারা এসেছিলেন এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জ  থেকে। আমার তখন বাল্যকাল। আমরা যে মাঠে ফুটবল খেলতাম, তার পাশেই ছিলো, তাদের ভাড়া বাড়ী। এবং সেই বাল্যবয়েসের টিমের গোলকিপার আমি প্রথম তড়িদাহত হয়েছিলাম সেই পরিবারের মেয়ে টিনা ও ব্রায়েনকে দেখে। আজ স্মৃতি ধূসর তাই অনেক কিছু বিশদে মনে পড়ছে না। কিন্তু এইটুকু মনে আছে,টিনা আমাদের বন্ধুবৃত্তে ছিলো। কয়েকজনের কাছে ব্রাত্য ছিলো কিন্তু আমার স্কুল ছিলো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, তাই আমার সাথে বন্ধুত্ব ছিলো বেশী।  সেই টিনার পরিবার যেমন হঠাৎ এসেছিলো, তেমন বছর ৩ বা ৪ পরে হঠাৎ তারা চলে যায়৷ কোথায় জানা নেই। সময়ের সাথে স্মৃতি হারিয়ে যায় কিন্তু সেই জায়গাটার নাম মনে থাকে।
 এর পর বেশ কয়েক বছর পরে আমার বাবা অফিস কলিগদের সাথে ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ বেড়াতে যান। ওঠেন অমি ঘোষ নামক এক জার্মানি ফেরৎ বাঙালীর হোম স্টে তে। তখনই এর ইতিহাস আর অলীকতা নিয়ে প্রথম শুনি।

তা সেই ৮ র দশকে যখন আমার সাথে টিনা ও ব্রায়েনের বন্ধুত্ব হয়,সেই সময়েই অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবভূগোলের অধ্যাপিকা কুন্তলা লাহিড়ী দত্ত ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ যান এবং তা নিয়ে দুটি সেমিনাল লেখা লেখেন— "Midnight's Orphans- Impressions of Mcluskiegunj" আর "In Search of Homeland— Anglo Indians and Mcluskiegunj"।  বস্তুত ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নিয়ে এত গভীরে কাজ খুবই কম আছে এবং এর আসল ইতিহাস এবং পরিণতি বুঝতে হলে এই দুটি লেখা অবশ্যপাঠ্য।  সাথে ওই অঞ্চলের বিভিন্ন গল্প ও চরিত্র জানতে হলে বিকাশ ঝা'র "ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ" ও অবশ্যপাঠ্য।
২০১৮ সালে আমি ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যাই। প্রায় একাই ঘুরে বেড়িয়েছিলাম চাট্টি নদী, জঙ্গল, গোরস্থান, ধ্বসে পড়া পোড়োবাড়ির অলিন্দে। অনেক কিছুই অনুভব করেছিলাম- অতীত, বর্তমান, অনাগত ভবিষ্যতের কাহিনীর। কিন্তু আমি লেখক নই, ভাষাজ্ঞান আর বর্ননা করার ক্ষমতা সীমিত, তাই ইচ্ছা থাকলেও লিখে উঠতে পারিনি। তাই শাক্যজিতের উপন্যাস হাতে পাওয়ার পর উৎসুক ছিলাম লালাবাবু, মুকুল ও কংকনা সেন শর্মা (আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ) র পর ম্যাকলাস্কিগঞ্জ কীভাবে উন্মোচিত হয় সেইটা দেখার জন্য।

"শিকারির ইতিহাস আর শিকারের ইতিহাস এক নয়। যে অ্যাংলো সাহেবরা এখানে সেটেল্মেন্ট করলেন এবং দিন ঢলে পড়াবার ক্রান্তিকালে আচ্ছন্ন থাকলেন বিগত যুগের মহিমায়,আর তাঁদের বন্দুকের গুলিতে যে অসং্খ্য বাঘেরা এই জঙ্গলে, তাদের ইতিহাস এক দাঁড়িপাল্লায় বসানো যাবে না। আপনারা গঞ্জে যখন আসেন ইউটোপিয়ার দিনাবসানে রোমান্টিক দুঃখ খুঁজে পান। আপনারা আস্থা রাখেন শিকারির ভাষ্যে" 

" আমাদের গঞ্জ এক ঘুমিয়ে পড়া টাউন... কটেজগুলো হয় পরিত্যক্ত, নয়তো বিক্রি হয়ে গেছে,অথবা নয়তো দখল। সবাই একে একে ছেড়ে চলে গেল। আমাদের অধিকার করল উপকথা,স্মৃতি ও রহস্যময় ফিসফাসের দল। শীতের থকথকে কুয়াশা ক্লান্তির মতো,আমাদের ভাঙা রাস্তা,ঘুপচি দোকানঘরের অন্ধ চোখ,পিয়ালের জঙ্গল...  দিনের একটা ট্রেন... দীর্ঘশ্বাসের মতো আমাদের অভ্যন্তরে চারিয়ে ওঠে.."

উপরোক্ত দুটি অনুচ্ছেদ শুধু এইটুকুই বোঝাতে দিলাম যে শাক্যজিত তাঁর উপন্যাসে ৩৬০ ডিগ্রি ভাবে গঞ্জের আত্মাকে ধরেছেন। তাঁর বর্ননার ভাষা অন্তত আমার কাছে চমৎকার লেগেছে। পরিমল ভট্টাচার্যর পর আবার এইরকম ভাষা পড়লাম। এইটুকু বলতে পারি ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নিয়ে ভবিষ্যতে যদি কেউ আগ্রহী হন,তার ইতিহাস থেকে বর্তমান,সেখানকার সমাজ ও রাজনৈতিক ভাবধারার দ্বন্দ্ব, সেটলার,মূলনিবাসী এবং আদিবাসী দ্বন্দ্ব, এই বই হয়ে উঠবে অবশ্য পাঠ্য।

কিন্তু ম্যাকলাস্কিগঞ্জ এর অকুস্থল হলেও এটি আসলে রহস্যকাহিনী।  সামাজিক রহস্য যা প্রতিফলিত হয় দুটি অন্তর্ধান এবং একটি হত্যায়। এবং এই ঘটনাগুলোর সময়ের ব্যবধান তা করে তুলেছে জটিল। দুটি পর্বের উপন্যাসের
প্রতিটি অধ্যায় শুরু হয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্ট /হিব্রু বাইবেলের প্রবাদ দিয়ে। এবং সেটি কাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত।  তার উত্তর পাঠক পাবেন উপন্যাসেই। এই রহস্য প্রথাগত তদন্তের পাশাপাশি স্বীকারোক্তির ও। বাইব্লিকাল কনফেশন ও বলা যেতে পারে। এ এক উত্তর খোঁজার যাত্রা। পাঠকদের মধ্যে যাদের কিইগো হিগাশিনোর "জার্নি ইন্টু দ্য মিডনাইট সান" বা ফরাসী লেখক মিশেল বুশির "আফটার দ্য ক্র‍্যাশ" পড়েছেন, বেশ কিছুটা ছোঁয়া পাবেন।

বিভিন্ন চরিত্রের প্রথম পুরুষের ভাষ্যে এগিয়েছে কাহিনী। ঢিমে আঁচে ধিকিধিকি ভাবে। কিন্তু রহস্যের গুমোট ভাব কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়। 
রহস্য কাহিনীর সমস্যা হল তার সমাধান। এখানে সমাধান বা উন্মোচন অনেকটাই হল কঞ্জেকচার। হতেও পারে বা না হতেও পারে। কিছু সূত্র দেওয়া আছে, আপাত সমাধানও দেওয়া আছে। সমস্যা হল অন্তত দুটি ক্ষেত্রে চরিত্রের পটপরিবর্তন টা আমার আরোপিত লেগেছে। এক সামাজিক ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা চরিত্রের এতটা পরিবর্তন—খটকা থেকেই যায়। 

কিন্তু এই ফাঁক আর প্রশ্নের দ্বন্দ্বই হল এই রহস্যকাহিনীর মূল সত্তা। একটি ইউটোপিয়া ধ্বংস প্রাপ্ত টাউনের সামাজিক ও পরিবর্তনের ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকল এই উপন্যাস।  তারই মাঝের র্‌হস্য ও মিথ হাত ধরাধরি  করে কিশোর কিশোরীরা জঙ্গলের পথ ধরে চার্চের ধারের পাহাড়ি টিলায় উঠে যায়। "কোনো কোনো কিশোরীর বয়স বাড়ে না বসন্তকালে।" সেই মেয়েদের হোঁচট খাওয়া গল্পেরা পা রাখে না যৌবনের চৌকাঠে"।  "নৈশ অপেরা" তেমনই এক কাহিনী কার্টেন কল।

পরিশেষে জানাই এই উপন্যাসের একটি চরিত্রের বর্ণনা পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। এত মিল!‌!! আর হ্যাঁ, টিনা দের সেই ভাড়াবাড়ি আশ্চর্যজনক ভাবে এখন এক পোড়োবাড়ি। জঙ্গল গ্রাস করেছে। আশেপাশে মাঠ নেই,সেখানে বাড়িতে ভর্তি। কিন্তু ওই বাড়িটা আজ প্রায় ভুতুড়ে। আসা যাওয়ার পথে রোজই চোখে পড়ে। ঠিক ম্যাক্লাস্কিগঞ্জের বাড়িগুলোর মতো।

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।