নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'নৈশ অপেরা' পড়ে নিজেদের পেজে মতামত জানিয়েছেন Journal of a Bookworm। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.........................................................
পাঠপ্রতিক্রিয়া : ২৯/২০২৫
নৈশ অপেরা
লেখক : শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রকাশনী : সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা।।
বছরের ২৯ নম্বর উপন্যাস, সুলেখক শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য এর লেখা তনয়া সিরিজ এর দ্বিতীয় বই, প্রথম বই ২০২২ সালের আমার পড়া সেরা রহস্য উপন্যাস ছিল "শেষ মৃত পাখি"।। তারপর এর মধ্যেকার সময়ে লেখকের একটি বই পড়েছি, ২০২৫ সালে নৈশ অপেরা এর প্রকাশের খবর পেয়েই বইটি বুক করি, হাতে পাওয়া মাত্র পড়া শুরু করেছি।। বইটির প্রচ্ছদ, পাতার মান খুব ভালো, বইটি পড়তে পড়তে বুঝেছি এই বই ঝড়ের গতিতে পড়ে ফেলার উপন্যাস নয়, সময় নিয়ে রসস্বাদন করার বই।।
একটা ভেঙে পড়া টাউন।। জঙ্গলের ভেতর চার্চ।। কিছু ভাঙাচোরা মানুষ।। রহস্যময় এক জলাভূমি।। বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক শিশু সেখানে মাঝে মাঝে দেখা দেয়।। অলৌকিক আখ্যান হতে পারে, হতে পারে রহস্যকাহিনি, অথবা কিছুই নয়।। হয়ত শুধুই বেদনার।।
তনয়া কি পারবে এই আখ্যানের ভেতর লুকিয়ে থাকা সত্যিটা খুঁজে বার করতে?
ঝাড়খণ্ডের একটি ছোট্ট টাউন নাম গঞ্জ, এক বিত্তশালী আংলো পরিবারের এক ছোট্ট শিশু হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়।। ঘটনাটি ঘটার প্রায় ৩০ বছর পর ২০২২ সালে সেই শহরে আসেন তনয়া ভট্টাচার্য্য।। আস্তে আস্তে পরিচিত হতে থাকেন এই মৃত শহরের কিছু মানুষ এর সঙ্গে।।পাঠক হিসেবেও আমরা পরিচিত হতে থাকি বারবারা ব্রাউন, এডওয়ার্ড, মনীষা, অ্যারন, জেনিফার, অবিনাশ যাদব, কিটি গোমস এর মত চরিত্রদের সাথে।। পেঁয়াজের খোসার মতো আমাদের সামনে পরতে পরতে উন্মোচিত হতে থাকে এক ভৌতিক রহস্য কাহিনী।। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই ৩০ বছরের পুরনো অমীমাংসিত রহস্যের সাথে জড়িয়ে পড়েন তনয়া।। জানতে পারা যায় হারিয়ে যাওয়া এই শহরে নতুন কিছু নয়।। এই শহরে আগেও কিছু মানুষ হারিয়ে গেছে, কিন্তু আগেই বলেছিলাম এই শহর ভৌতিক।। তাই হারিয়ে যাওয়ার পরেও ছোট্ট ক্রিসকে ৩০ বছর ধরে এক রহস্যময় জলাভূমির ওপর ঘুরতে দেখেন তার পিসি বারবারা।। আরো একটি মেয়ে যে হারিয়ে গেছিল সেই অ্যাগনেসকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে দেখতে পায় বিভিন্ন মানুষ।। লেখকের লেখনীতে তৈরি হয় অদ্ভুত কিছু দৃশ্য কল্প।। একটি মেয়ে যাকে তনয়া জিপসিদের রাজকন্যা বলতো সে শহরের বিভিন্ন জায়গায় সাদা রঙের একটি জামা আর মাথায় একটি মুকুট পড়েঘুরে বেড়াত, রেভারেন্ড গরম্যান কে আমরা প্রথম দৃশ্য দেখতে পাই একটি জঙ্গলের মধ্যে খালি গায়ে একটি ফোনের রিসিভারকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন।। একটি মৃত শহর, ভেঙে পড়া সাহেবী আমলের বাংলো, জঙ্গলের মধ্যে এক ভাঙ্গা রহস্যময় চার্চ এবং হারিয়ে যাওয়া কিছু মানুষ, এই নিয়ে প্রথম পর্বে লেখক সময় নিয়ে বুনেছেন রহস্যের জাল, সেখানে রহস্যের সাথে সাথে রেখেছেন ভৌতিক কিছু উপাদান।। গল্পের প্রথম ভাগ যেখানে শেষ হচ্ছে অর্থাৎ রহস্য এবং প্লট যেখানে ফাইনালি গঠন করে ফেলেছেন লেখক, সেই জায়গায় এসে রয়েছে গল্পের এমন এক টুইস্ট যা সত্যিই আনএক্সপেক্টেড।।
এরপর শুরু হয় গল্পের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ যেখানে রহস্য উন্মোচনের পালা।। বিশেষ এক কারনে তনয়াকে এই রহস্য অমীমাংসিত রেখেই সেই সময়ে মানে ২০২২ সালে গঞ্জ থেকে ফিরে আসতে হয়।। কিন্তু তিন বছর পর তনয়াকে আবার ফিরতে হয় এই গঞ্জে একটি বিশেষ ঘটনার জন্য।। দ্বিতীয় ভাগে সেই ফিরে আসা এবং রহস্য উদঘাটন।। পাঠক হিসেবে এরকম বহুস্তরীয় মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস বাংলায় আমি অন্তত আগে পড়িনি।।অপরাধ একটা ছিল না, ছিল বেশ কয়েকটা অপরাধ যা ঘটেছিল বেশ কিছু বছর ধরে।। যেটা তনয়ার আগে অবিনাশ যাদব ধরতে পারেননি তা হল এই অপরাধগুলোর মধ্যে কিছু কানেকশন ছিল।। তনয়ার মাধ্যমে রহস্যের আংশিক উন্মোচন সম্ভব হয় এবং বাকিটা পাঠক হিসেবে আমরা জানতে পারলেও তা তনয়ার কাছে অজানাই থেকে যায়।।
পাঠ প্রতিক্রিয়া—
আমি কোনরকম তুলনা তে যাবো না, কোন বইটি ভালো বেশি ভালো লেগেছে।। শেষ মৃত পাখি পারফেক্ট ক্রাইম নিয়ে আমার পড়া সেরা একটি উপন্যাস, নৈশ অপেরা অনেক বেশি সিনেমাটিক এখানকার প্রত্যেকটি দৃশ্য লেখক এত সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন, মনে হচ্ছিল পাঠক হিসেবে আমি জোহার হালে তে দাঁড়িয়ে আছি অথবা তনয়ার সাথে জঙ্গলে রাস্তা হারিয়েছি, অথবা জলাভূমি ওপর প্রান্তে এম্বাসেডর গাড়িটি আমিও দেখতে পারছি।। পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন প্রতিটি দিককে অথচ একটা সূক্ষ্ম শিহরণ ঢেলে দিয়েছেন কাহিনীতে, আর এটাই আমার মনে হয়েছে শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্য এর ইউএসপি।। পুরো দিকটাই তিনি এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন পাঠক প্রতিটি চরিত্রের মানসিক টানাপোড়েনের সঙ্গী হতে পারে শেষ অব্দি।। চরিত্রগুলোর সাথে খুব সহজে মিশে যাওয়ার যে প্রবণতা সেটা হয়ত লেখকের গল্প বুননের সার্থকতা।। লেখক গল্পের প্রথম পর্বে জটিলতা, গঞ্জের পরিবেশ এবং জীবিত ও ভৌতিক চরিত্রগুলো পাঠক এর সামনে এমন ভাবে তুলে ধরেছেন যাতে পাঠক প্রথম থেকেই একটা মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে বিভ্রান্ত হোন, উপসংহারে পৌঁছে তনয়া, বারবারা অথবা অ্যারন এর মত পাঠকদের ও মনে হবে এই রহস্যের উন্মোচন হওয়া কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল।। যদিও সব রহস্যের কোনো যথার্থ কারণ থাকতে নেই, কিছু রহস্য হয়ত না খুঁজলেও চলে।।
Comments
Post a Comment