প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।
মহাবনস্থিত তাঁদের বনস্থলী হতে রওনা দেবার পর দ্বিতীয় দিবসে নির্বিঘ্নে নিরুদককান্তার অতিক্রম করার জন্য উল্লাস উপভোগের পর ক্ষণিক বিমনস্কতার ফলে তৃতীয় দিবসে অরণ্যমধ্যে পথভ্রষ্ট হয়ে অষ্টপ্রহরাধিক কাল তাঁরা তরুরাজির মধ্যে ইতস্তত বিচরণ করেছেন। অবশেষে যাত্রভেদক অপভ্রমণ করতে করতেই তাঁরা একটি বনসবতির দেখা পান।
প্রথমে এই মানুষগুলিকে অপযক্ষ বলে ভ্রম হয়েছিল— নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অধিকাংশজনই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, পাথুরে বলশালী চেহারা, কৃষ্ণপ্রস্তরে গড়া প্রতিরূপের মতো— অরণ্যতরুর আড়াল হতে পঞ্চ-ভিক্ষুককে তারা লক্ষ্য করছিল।
ভয় পেয়েছিলেন দীপ্তঙ্করও।
কিন্তু বনচারী মানুষগুলি অনেক অভিজ্ঞ, এই বনপথে যাতায়াতকারী বৌদ্ধভিক্ষু তারা অনেক দেখেছে। সন্ন্যাসীদের ভাবভঙ্গি দেখেই তারা অচিরেই বোঝে যে, এই ভিক্ষুদল বনধাঁধায় পথ হারিয়েছেন।
শূন্য হতে আবির্ভাবের মতো আড়াল ছেড়ে ত্রস্ত সন্ন্যাসীদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এক নারী ও পুরুষ। নিরস্ত্র। দু-জনেরই দুই হাত অর্ধভঙ্গিতে ওপরে তোলা।
মধ্যবয়স্ক সেই পুরুষ ও নারীর পরনে তরুবল্কল হতে তন্তুনিষ্কাষণ করে তাইতে গড়া হ্রস্বমাপের কটিবস্ত্র, পুরুষটির উর্ধাঙ্গ অনাবৃত, নারীর উর্ধাঙ্গে পটিবক্ষবন্ধনী।
তারপরের কথা অনেকটা সারবানবিহারে বর্ষাবাসিত দূরদেশী ভিক্ষুদের কথিত আখ্যায়িকার মতো!
এই দম্পতি বনবসতির দলপতি। নাম তাঁর চিত্তক। তাঁদের কাছ হতে জানা গেল গত রাত্রি থেকেই বনবসতির মানুষগুলো বৃক্ষান্তরালে থেকে এই সন্ন্যাসীদলকে অনুসরণ করছিল।
কিছু বনচারী মানুষ।
এরা শুধুমাত্র বনফল, ক্ষুদ্র বনজীবের মাংস এবং গিরি-নিঃসৃত জলধারা, প্রাকৃতিক কুণ্ডগুলির মৎস্যের ওপর নির্ভর করে দিন যাপন করে। পরিধান করে বৃক্ষবল্কল হতে প্রস্তুত অপবস্ত্র।
এমনভাবে নিতান্ত পণছত্তক দেওয়া পর্ণকুটিতে মানুষ বাস করতে পারে তা না-দেখলে নবীন ভিক্ষুদল বিশ্বাসই করতেন না। এঁদের স্থায়ী সম্পদের মধ্যে আছে কয়েকটি অরণ্য-ছাগ বা 'এলক', কুক্কুটি বা 'পক্ষীধেনু'।
কিন্তু দীপ্তঙ্করের মনে হলো বস্তুসম্পদহীন এই নিতান্ত অকিঞ্চন মানুষগুলো কত স্বাধীন, কতটাই আত্মনির্ভরশীল— 'অত্তকত' জাতি এবং এদের দলপতি স্বয়ং স্বল্পভাষী— 'অত্তকার'।
আশঙ্কায়, অকারণ চক্রভ্রমণে, ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ভিক্ষুদলকে এই বনবাসীর দলই কোনোরকম ধর্মকথার বিনিময় ছাড়াই আতিথ্য দিল, ক্ষুধার অন্ন দিল, তৃষ্ণায় দিল শীতল জল, রাত্রিযাপনের জন্য দিল অস্থায়ী পণছত্তক এবং মৃত্তিকায় রচিত পণভিসি।
নিজেদের বনস্থলী থেকে নির্গত হওয়ার পর এই প্রথম চিত্তকদের প্রহরায় দীপ্তঙ্করেরা রাত্রে নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেলেন।
এদের একটি দল পালাক্রমে রাত্রিবেলা চতুর্দিকে ভ্রমণ করে। বন্যজন্তু, বনদস্যুদল এবং কোলাহলকারী, মদ্যপায়ী, অনাচারী ভ্রাম্যমান বণিকদলের হাত থেকে নিজগোষ্ঠীর লোকেদের রক্ষা করে। এরা একই সঙ্গে 'রত্তিচর' এবং 'রত্তিকখিত্ত'—রাত্রিচর এবং রাত্রিকালীন শিকারী বা লক্ষ্যভেদকারী! এরা নিজেদের একলব্যের বংশধর বলে মনে করে—সেই একলব্য— নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র। অন্ত্যজশ্রণীর মানুষ বা শূদ্র হওয়ায় অস্ত্রগুরু ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য যাঁকে শিষ্যত্বে বরণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু দ্রোণাচার্যকেই গুরু মেনে একলব্য স্বশিক্ষানুশীলনের বলে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হয়েছিলেন। আর পাণ্ডব ও কৌরবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য রাজপুত্রদের, বিশেষভাবে অর্জুনের শ্রেষ্ঠধনুর্ধর হিসেবে স্বীকৃতির স্বার্থে একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ গুরুদক্ষিণা হিসেবে চেয়ে নিয়ে চিরতরে একলব্যের ধনুর্ধর হওয়ার সাধ ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিলেন! হাসিমুখে একলব্য দিয়েছিলেন গুরুদক্ষিণা।
সেই একলব্যের বংশধর! এরাও হাসিমুখে ভিক্ষুদলকে নিজেদের কষ্টার্জিত শস্যকণা, বনশশকের পলল, বনফুলের মধু এবং বনজ আখের নির্যাস দিয়ে আপ্যায়িত করল। এসবের বিনিময়ে চিত্তক একবারও ভিক্ষুদের বাসবিহার, গমনপথের হদিশ কিংবা আগমনের কারণ, কিংবা পরিচয়—কিছুই জানতে চাইলেন না। নম্র নমস্কার ভিন্ন অযথা ভক্তিপ্রদর্শনও করলেন না, গললগ্নিকৃতবাসে প্রণতি জানালেন না। অসংবৃত তো বটেই সংবৃত কৌতূহলও এরা প্রকাশ কেউ করলেন না। দীপ্তঙ্কর মনে মনে লজ্জিত হলেন। কোনোরকম পুঁথিনিগত শিক্ষা ছাড়াই এই সামান্য নিষাদ-দলপতি এবং তাঁর গোষ্ঠীর মানুষেরা সন্ন্যাসীর থেকে বেশি নির্লিপ্তি অর্জন করেছেন!
দীপ্তঙ্কর নিজেদের, ভিক্ষুদের সকলের পরিচয় দান করলেন। চিত্তক একটিও ধর্মকথা উচ্চারণ করলেন না, ভিক্ষুদের কাছে উপদেশিয় কথকতা শ্রবণ করতে চাইলেন না, দেশনা যাচন করলেন না। শুধুমাত্র আহারের পরে জিজ্ঞাসিত হয়ে এই ভূমপ্পদেশ, এর পশুপক্ষী, জীববৈচিত্র্যের বিচিত্রকথা, জলধারাসমূহের অবস্থিতি ও কার্যকারিতা, ঋতুচক্রের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনমান যাপনকথা ব্যক্ত করলেন!
সখ্যমূলক আতিথ্য দানের পর প্রাক্-দিবসে এই বনচরদলের মুখ্যপুরুষ চিত্তক—তিনি স্বয়ং অরণ্যপ্রান্তে, যেখানে বনভূমির তরুদলের সখ্য অনেক বিচ্ছিন্ন—পাতলা হয়ে এসেছে অরণ্যভূমি—দূরে আবছা কুহেলিকার মতো দেখা যায় নগরপ্রাকার—সেই পর্যন্ত ভিক্ষুদলকে পৌঁছে দিয়ে গেছেন।
.......................................…,…
প্রতিযাত্রা
দুর্লভ সূত্রধর
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৪৮০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment