অভিমানভূম।। শুভদীপ চক্রবর্তী।। সুপ্রকাশ।।
বঙ্গভঙ্গ আটকাতে যে বিপুল উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল কলকাতা শহরে এবং তার যে পরিমাণ প্রচার হয়েছিল, সেটার প্রায় কিছুই হয়নি যখন মানভূমকে বাংলার বুক থেকে কেটে নিয়ে বিহারের অংশ করে দেওয়া হয়। তবে মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী সম্প্রদায় একদমই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি এই বিচ্ছেদ। যে হিন্দি আগ্রাসন নিয়ে বর্তমানে এত তোলপাড় সারাদেশে, ভাবলে অবাক লাগে এই একই আন্দোলন সেই সময় মানভূমের মানুষ শুরু করেছিলেন মোটামুটি ১৯১২ সাল থেকে, যা চলে স্বাধীনতার পর অবধিও! বহু ভাষাতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিক গবেষকেরাও স্বীকার করেছেন, ভাষার অধিকারের জন্য মানভূমের এই আন্দোলনকে পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন বলাই যায়।
মানভূমের বাংলাভাষী বাসিন্দারা স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতার পরে আবার তাঁরা ফিরে আসবেন বাংলার বুকে। কিন্তু দীর্ঘ প্রচেষ্টায় স্বাধীনতা এলেও, তাঁদের সেই দাবীদাওয়া পূরণ হল না একটাও। অতএব এবার আন্দোলন শুরু হল স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর থেকেই। মানভূমের বাঙালিদের মধ্যে তীব্র ভাবে ছড়িয়ে পড়ল ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন। শেষে ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে চরমে পৌঁছোয় আন্দোলনের তীব্রতা। মাথার উপর গনগনে সূর্য। তারমধ্যেই আমাদের এই পুঞ্চা এলাকারই পাকবিড়রা গ্রাম থেকে প্রায় এক হাজার মানভূমবাসী পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন কলকাতার পথে। টানা সতেরো দিন হাঁটার পর মিছিল কলকাতা পৌঁছোলে, লালমাটির বিরুদ্ধতার ঝাঁজ টের পেয়েছিল রাজশক্তির শহর। অবশেষে এই আন্দোলনের কাছে মাথা ঝোঁকাতেই হয় সরকারি উপর মহলকে। ১৯৫৬ সাল। পয়লা নভেম্বর আসে খবরটা। উল্লাসে ফেটে পড়েন মানভূমবাসী। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে পুরুলিয়া জেলাকে! ওখানে থাকতেও দেখেছি, পয়লা নভেম্বর দিনটা রীতিমতো সারা জেলাতেই পালন করা হয় পুরুলিয়ার জন্মদিন হিসেবে।
কোথাও দেখার বা পড়ার আগে পুরুলিয়া জেলার এই ইতিহাসের ব্যাপারে জানা গিয়েছিল শেখরদার চায়ের দোকানে বসে। আমার থাকার বাড়িটা থেকে স্টুডিয়ো অবধি রাস্তায় চায়ের দোকান মোটামুটি দুটো। যে বাড়িতে থাকি, তার উল্টোদিকেই ভগবানদার দোকান, আর, কলেজের ঠিক পাশে শেখরদার দোকান। মোটামুটি বাইরে ঘোরাঘুরি না থাকলে, সকালে দশটা থেকে দিনের বাকি সময়টা কাজের ওখানেই। তাই বেশ খানিকটা সময় কেটে যায় শেখরদার দোকানে। শেখরদারা পাঁচ ভাই। বড়ো ভাই ওভারশিয়ার। শেখরদার আগের ভাই বিখ্যাত 'লেডুদা' নামে। বাকি দুই ভাই, তপনদা আর পলাশদা। খুবই অদ্ভুত একেকটা চরিত্র এবং সময় সময় একটু খ্যাপাটে মনে হলেও, শেখরদা, তপনদা বা পলাশদা খুবই গভীরভাবে মিশে এই জেলার সংস্কৃতির সঙ্গে।
......................................................
চায়ের দোকানে বসেই নাকি দেখে ফেলা যায় একটা গোটা সমাজ, এরকম একটা লাইন কি কেউ লিখে গিয়েছিলেন আগে? লিখে না থাকলেও, সত্যিই যে চায়ের দোকানে বসে একটা গোটা সমাজ ব্যবস্থার মোটামুটি একটা ছবি এঁকে ফেলা যায় চোখের সামনে, সেটা বুঝতে পারি বেশ। ভগবানদার দোকানের তুলনায় শেখরদার চায়ের দোকানে ভিড়টা একটু বেশিই। তার কারণ, দোকানটা একদমই লৌলাড়া কলেজ বা ছেলেমেয়েদের স্কুল আর হোস্টেল সংলগ্ন। ছুটির দিন ছাড়া প্রায়ই চায়ের দোকানের সামনে লেগে থাকে ছেলেমেয়েদের ভিড়।
ট্রেনের মতোই সময় মেনে এখানকার রাস্তার ধারে যাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বাসের জন্য। বেশিরভাগ বাসই পুরুলিয়া-মানবাজার রুটের। দু-একটা আবার বাঁকুড়া বা ঝাড়গ্রাম। একেকটা বাস এসে থামলে, গাদাগাদি করে উঠে যায় ছেলেমেয়ের দল। ধুলো উড়িয়ে চলে যায় বাস। আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েই সব। অনেক দূরের গ্রাম থেকে বা পড়শি বাঁকুড়া বা মেদিনীপুর জেলা থেকে যারা পড়তে আসে, তাদের থাকতে হয় ছেলে আর মেয়েদের জন্য আলাদা করা নির্দিষ্ট হোস্টেলে। কলেজ চত্ত্বরের ভিতরে একটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। বাইরের বড় রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু লোহার দরজা থেকে শুরু হয়ে সেটা চলে গেছে একদম পিছনের বড়ো মাঠ অবধি। বড়ো মাঠ মানে ঠিক কতটা বড়ো, সেটা বলে বোঝানো মুশকিল। 'দিগন্তবিস্তৃত' এর জন্য একদম ঠিকঠাক একটা শব্দ। মাঠের পাশে বেশ কিছুটা চাষ জমি। শোনা যায়, একসময় নাকি এই জমির ফসল বিক্রি করে সেই অর্থেই চালানো হতো স্কুল-কলেজের খরচা। সন্তান-সন্ততির শিক্ষার খাতিরে চাষ করতেন স্থানীয় মানুষেরাই। এইসবই যদিও শোনা-কথা এখানকারই নানান মানুষজনের কাছ থেকে, তবু এখন মাঝেমধ্যে মনে হয় যদি ব্যাপারটা সত্যি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে বিকল্প রাজনীতিতে যে 'কমিউন' বা বা 'সকলের তরে সকলে আমরা'র কথা বলা হয়ে থাকে, এর থেকে ভালো উদাহরণ তার জন্য আর কীই বা হতে পারে?
......................................................
অভিমানভূম
শুভদীপ চক্রবর্তী
................................
প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment