প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।
বুদ্ধ্যাসনে তর্জনী এবং কনিষ্ঠ অঙ্গুলি তুলে এবং অপর অঙ্গুলিগুলি ভাঁজ করে মধ্যমার সঙ্গে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ স্পর্শ করে করণমুদ্রায় আসীন ছিলেন উপাচার্য মহাপ্রভাতি। সাধারণভাবে এই মুদ্রা অসুস্থতা বা নেতিবাচকতার হ্রাস ঘটাতে সহায়তা করে বলে কথিত আছে। কিন্তু করণমুদ্রায় আসীন হয়েও মহাপ্রভাতির অবস্থানিক অস্বস্তি মহাঅনিন্দ্যর নজর এড়ালো না।
জিজ্ঞাসাপর্বের পরিসমাপ্তি ঘোষণার মতো করে ভিক্ষু পরিপালক বললেন—'ভদন্ত, আপনি আমাদের প্রাত্যহিক উপদেশ করুন।'
আচার্য মহাকনককাঞ্চন ক্ষণিকের জন্য চক্ষু মুদিত করলেন, অতঃপর উন্মীলন করে বললেন—'আমার সাধ্য কি উপদেশ করার। সেই মহাকারুণিক আমাদের ক্ষমা করুন। ভিক্ষুর প্রচ্ছাদন ধারণ করে বিনাশ্রমে অসৃজন সুখ ভোগ করছি আমরা। সঙ্ঘজীবনে সম্বিৎটুকু ব্যতিরেকে 'নিজন্ত' কিছুর প্রকৃত অস্তিত্ব না-থাকা সত্ত্বেও আমরা ক্রমাগত একে অপরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে চলেছি—আজ হোক সেই অভীপ্সিত ভিক্ষু-কথা—'ভিক্খুবগগো'—'
'ভিক্খুবগগো'-র শ্লোকসমূহ বহুপঠিত ও কণ্ঠস্থ থাকা সত্ত্বেও আচার্যের সুমধুর কণ্ঠস্বরে সুপুণ্যকের 'মজ্জভাগ' ও অন্তঃস্বরের চিত্তাত্মা চমকে উঠল যেন! আচার্য বলছিলেন—
'চক্ষুসংযম করেন সাধু, সাধু করেন কর্ণসংযম, সাধুর ঘ্রাণ সংযমিত থাকে ও সাধু জিহ্বা সংযম করেন।
'কায়িক সংযমে থাকেন সাধু, বাচনিক সংযমে থাকেন সাধু, মানসিক সংযমে থাকেন সাধু, সর্ব সংযম সাধুর আচরণ। ভিক্ষু সর্বথা সংযত থাকেন, ভিক্ষু যাবতীয় দুঃখ হতে বিমুক্ত হন। তিনিই প্রকৃত ভিক্ষু যিনি হস্ত, পদ ও বাক্যে সংযমী, অধ্যাত্মরত, সমাহিতচিত্ত, সন্তোষপরায়ণ ও নিতান্ত অনাসক্ত।
'যে ভিক্ষু বাকসংযমী, মন্ত্রভাষী—অনুদ্ধতভাবে ধর্ম ও ধমার্থ ব্যাখ্যা করতে সমর্থ তাঁর ভাষণই মধুর হয়।
'প্রাজ্ঞ ভিক্ষুর প্রাথমিক কর্তব্য এই : ইন্দ্রিয় সংযম, সন্তোষ এবং প্রাতিমোক্ষ পালন, শুদ্ধাজীব অতন্দ্র কল্যাণমিত্রদের সাহচর্য করা প্রয়োজন। প্রতিসেবা ও আচারকুসল হওয়া প্রয়োজন। আনন্দবহুল ভিক্ষু যাবতীয় দুঃখের অন্তসীমা স্পর্শ করতে সমর্থ হন।
'যাঁর কায় শান্ত বাক্য শান্ত, এবং মন শান্ত ও সুসমাহিত হয়েছে, যিনি লৌকিক ও বাসনাবিহীন হয়েছেন—সেই ভিক্ষুই উপশান্ত বলে কথিত হন।
'যে ভিক্ষু সতত ধর্মচিন্তা করেন, ধর্ম-প্রসঙ্গে আনন্দ লাভ করেন, ধর্মকে সতত অনুসরণ করেন—সেই ভিক্ষু সদা-সর্বদা সধর্মের সমীপে অবস্থান করেন।
'নিজেই নিজের প্রেরণা, নিজেই নিজের প্রহরী, নিজেই নিজের পরীক্ষক হয়ে-ওঠার প্রয়োজন। হে ভিক্ষু! যিনি আত্মগুপ্ত ও স্মৃতিমান্ তিনি সুখে বিহার করেন।
'নিজেই নিজের গুরু, নিজেই নিজের প্রভু, নিজেই নিজের আশ্রয়। সুতরাং বণিকের ভদ্র অশ্বের মতো নিজেকে সংযত করা প্রয়োজন।
'নিতান্ত তরুণ হলেও যে ভিক্ষু বুদ্ধশাসনে আত্ম নিয়োগ করেন, তিনি মেঘমুক্ত চন্দ্রের মতো এই জগৎকে উদ্ভাসিত করেন।
'ইতি শান্তি। শান্তি। শান্তি।'
নীরব হলেন আচার্য।
সমগ্র বনস্থলীতে নেমে এল সমগ্র বনভূমির নিজনতা।
দিনের আলো আসন্ন পূর্ণমাসীর চন্দ্রাভার সঙ্গে মিশে নির্বিকল্প নিরবলম্ব শান্তি এবং বহুজনের মধ্যেও অপূর্ব এক একাকিতা সৃজন করল।
সংযম!
চমকালেন সুপুণ্যক। কোন সংযমের কথা বলেছিলেন বুদ্ধ? কোন তরুণ সন্ন্যাসীর কথা বললেন আচার্য! তাঁর এবং অভিদীপ্তের আসনস্থলে যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল আচার্যের! অন্তর্লোকের সকল অনান্ধকার অবলোকন করবার মতো তিনি কি তৃতীয় নয়নের অধিকারী! সেই তৃতীয় নয়নের 'নাণদসন'-এ তিনি কী সবই দেখতে পান, টের পান প্রিয়শিষ্যদের অস্থির প্রহরগুলির অসংযিমত ইন্দ্রিয়-অকুসলতাকে! কোন সংযমের ইঙ্গিত করছেন আচার্য মহাকনককাঞ্চন! সে-কী জুঁই ফুলের ঘ্রাণানুসরণ থেকে সংযম? নাকি সেই দানপাত্রধৃত সুললিত হস্তের চিত্রিত কনকাঙ্গুলির দৃশ্যায়ন থেকে নেত্রদ্বয়কে বঞ্চনা?
চারপাশে তাকালেন সুপুণ্যক।
এই সময়ে স্বস্তিদায়কভাবে ভিক্ষু অভিদীপ্ত ঠিক তাঁর পাশটিতে উপস্থিত থাকায় ভারি একটা নির্ভরতার বোধ জাগল সুপুণ্যকের মধ্যে! কিন্তু সেই ছায়ান্ধকারে অভিদীপ্তের মুখভাব জরিপ করা সম্ভব ছিল না। 'অহো! সৌভাগ্য এই যে, জুঁইগন্ধবিমথিত আমার মুখাভিব্যক্তি অভিদীপ্তও দেখতে পাচ্ছে না!'— অন্তঃস্বরে বললেন সুপুণ্যক।
.......................................................
প্রতিযাত্রা
দুর্লভ সূত্রধর
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৪৮০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment