লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।
কলকাতাসহ মফস্বলের অধিকাংশ লেটারপ্রেসই ছিল ক্ষুদ্র বা মাঝারি। এমন প্রেস মফস্বল শহর, গ্রাম বা গঞ্জের অলিতে-গলিতে ছিল যেগুলি ছিল মুখ্যত ঐ 'ওয়ান-ম্যান' লেটারপ্রেস বা একক শ্রমনির্ভর—পুরোপুরি হস্তসাধক এবং প্রাথমিকতম প্রযুক্তিরও ছোঁয়াচহীন। এই ধরনের প্রেসের প্রত্যক্ষ উদাহরণ ছিল দাদাঠাকুর নামে খ্যাত শরৎচন্দ্র পণ্ডিত (১৮৮১-১৯৬৮)-এর 'পণ্ডিত প্রেস'। নিজের প্রেস ও পত্রিকা নিয়ে তাঁর রোমহর্ষক সংগ্রাম উল্লেখ করবার মতো। তা গ্রামবার্ত্তার প্রেস নিয়ে হরিনাথের সংগ্রামের মতোই অত্যাশ্চর্য, কৌতূহলোদ্দীপক।
শৈশবে পিতামাতাকে হারিয়ে কঠোর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত জঙ্গিপুর হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে আর বেশিদূর প্রথাগত পড়াশুনোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। ১৯০২-১৯০৩ সাল নাগাদ তাঁর অভিভাবক, পিতৃব্য রসিকলাল পণ্ডিতের পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় স্বাধীন জীবিকার সন্ধানে তিনি স্থাপন করেন পণ্ডিত প্রেস, জঙ্গিপুর মহকুমার প্রথম (নিমতিতার জমিদারবাড়ির নিকটবর্তী 'গোবিন্দ প্রেস'-এর কথা বাদ দিলে) ছাপাখানা। এই প্রেস স্থাপনার ইতিহাস যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনই কৌতুকপূর্ণ।
বস্তুত দাদাঠাকুর যে-বয়সে প্রেস স্থাপন করেছিলেন, সেই ২১-২২ বছর বয়স পর্যন্ত ছাপাখানা বিষয়ে তাঁর বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। হাতেকলমে কাজ জানা তো দূরের কথা! তাঁর কাছে প্রেস ক্রয় করার পুঁজিও তেমন কিছু ছিল না। শুধু তাঁর মনে হয়েছিল একটা ছাপাখানা করতে পারলে স্বাধীনভাবে সংসার প্রতিপালন করা সম্ভব হতে পারে। প্রিন্টিংপ্রেসের সরঞ্জাম বিক্রির বিজ্ঞাপন বা প্রতিবেদন দেখে মাত্র পঞ্চাশটি টাকা সম্বল করে শরৎচন্দ্র কলকাতায় এসে ছেচল্লিশ টাকা দিয়ে কাঠের পুরোনো একটি প্রেস ও প্রেসের অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করেন (এবং উপহারস্বরূপ পাওয়া ছ-আনা দামের একটি 'প্রিন্টার্স গাইড' পুস্তিকাসহ)।
প্রথমে দাদাঠাকুরের জঙ্গিপুরের গ্রামের বাড়ি দফরপুরে প্রেসটি স্থাপিত হয়। এই প্রেসে প্রথমে খুচরো ছাপার কাজ হতো। প্রেসে কোনোরকম প্রয়োজনীয় প্রেসীয় আসবাবপত্র ছিল না। টাইপ কেসের অভাবে প্রেসের মাটির মেঝেতে গর্ত করে মাটির ভাঁড় বসিয়ে তাতে টাইপ ডিস্ট্রিবিউট করা হতো। প্রেসের মালিক বা প্রোপাইটর, ম্যানেজার, কম্পোজিটর, প্রুফ-রিডার, টাইপ ডিস্ট্রিবিউটর, প্রুফ উত্তোলনকারী, ইঙ্কম্যান—সবই ছিলেন শরৎচন্দ্র নিজেই। শুধুমাত্র মেশিন চালনায় অর্থাৎ ছাপার কাজে তাঁকে সহায়তা করতেন তাঁর স্ত্রী। প্রেসম্যানের বদলে প্রেস-উওম্যান—অর্থাৎ তাঁরা 'স্বামী-স্ত্রীয়ে' প্রেস চালাতেন।
দাদাঠাকুর ১৯১৪ সাল নাগাদ প্রকাশ করেন সংবাদপত্র'— জঙ্গিপুর সংবাদ', ১৯২২ সাল নাগাদ দাদাঠাকুর প্রকাশ করেন 'বিদূষক' পত্রিকা। সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন ব্যঙ্গাত্মক প্রকাশনা 'বোতলপুরাণ'— বোতলের আকারে কালো কাগজ কেটে তার মধ্যে লাল কাগজে ছাপা কবিতা-গান। এই পত্রিকাগুলি প্রকাশনার ফলে প্রেসের অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হয় কপি প্রস্তুকারক ও কপি-সংশোধকের ভূমিকা— এডিটরিও। কখনও এক-আধজন সাহায্যকারী জুটলেও পত্রিকাসমূহের লেফাপা লেখক, ডাকবন্দিকারক, প্রেরক, বিজ্ঞাপন সংগ্রাহক-এমন কি বিতরক (আক্ষরিক অর্থে পত্রিকা-হকার)—বিক্রেতাও ছিলেন শরৎচন্দ্র নিজেই।
পত্রিকা ছাপার জন্য একটু উন্নত মানের ছাপাখানার প্রয়োজন হলো। শরৎচন্দ্র পুনরায় কলকাতায় এলেন। এক সাহেবের কাছ থেকে উন্নত মেশিন কিনলেন। এত পরিশ্রমেও শরৎচন্দ্রের সাংসারিক অবস্থা ও আর্থিক সঙ্গতির উন্নতি খুব সহজে হয়নি। এই প্রেসে প্রথমাবধি খুচরো কাজ হতো, সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গিপুর মহকুমার একমাত্র সংবাদপত্র হওয়ায় জঙ্গিপুর সংবাদে সরকারি বিজ্ঞাপন ও নিলাম ইস্তাহার ছাপা হতো। তবু প্রেসের উন্নতি ও সাংসারিক আয়ের সংস্থান করার জন্য তাঁকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সে এক ভিন্ন-প্রসঙ্গ।
.................................................
লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা
অনন্ত জানা
................................................
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment