নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ।।
জেমস ফোর্টকে পাশে রেখে কিছুটা এগিয়ে গেলে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাবেজ পাম গাছগুলো চোখে পড়ে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের দল তালের মতো ঢ্যাঙা গাছেদের আড়লে লুকোচুরি খেলছিল। কোকো ওদেরই একজন। ঝাঁকড়া চুল। দুষ্টুমি ভরা হাসি। ভীষণ ছটফটে ছেলেটা তার এবং আইয়ানার মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তাকে দেখতে পেয়েই খেলা ছেড়ে ছুটে এসেছিল কোকো। তারপর ব্যস্তসমস্ত ভাবে বলেছিল, 'আইয়ানা নেই। কিটচি মানিতোউ-এর কাছে চলে গেছে।'
বলেই ছুটে একটা ক্যাবেজ পামের পেছনে আড়াল নিয়েছিল। অ্যালগংকুইনদের আরাধ্য দেবতা হলেন কিটচি মানিতোউ। কোকোর বলা কথাগুলো অনেকক্ষণ পিটারকে নড়তে দেয়নি। পৃথিবী বুঝি নিজের নিরন্তর আবর্তন থামিয়ে দিয়েছিল ওই সময়টুকুর জন্য। তারপর কখন যে তার অবাধ্য পা নুড়িমাখা পথ ধরে আইয়ানাদের গ্রামের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিল, পিটার নিজেও জানে না। মাথায় রঙিন কাপড়ের ফেটির ভাঁজে লম্বা পালক গোঁজা এক সুদেহী তরুণ সবাইকে সরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। যেন জীবন্ত আগ্নেয়গিরি! তার পরেই প্রবল জিঘাংসায় ফেটে পড়ল। শক্ত হাতে পিটারের জ্যাকেট ধরে তাকে ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে। ঘিরে থাকা ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ সজোরে লাথি কষাল তার পেটে। পিটার জানে না সে কী অপরাধ করেছে, তবুও নিজেকে লুকোতে চাইল না। 'আইয়ানা নেই', এই একটা কথা তার সমস্ত দৈহিক অনুভূতি, আগ্রহ শুষে নিয়েছে। আইয়ানা নেই যখন, তার কাছেও পৃথিবীর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তরুণ ছেলেটি কে পিটারের জানা নেই। সে শুধু ছেলেটির উন্মত্ত আক্রোশের সামনে নিজেকে নিঃশর্তে মেলে ধরল। আর তখনই, খুব কাছে কারোর বন্দুক গর্জে উঠল। একবার। তারপর আবার।
তার অসাড় চোখের পাতা খুব কষ্টে ঠেলে সরাল পিটার। জন হোয়াইট, সঙ্গে লাল পোশাকের সেপাই। দু'জন সেপাই ঘোড়া থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে এল। পথ রুখে দাঁড়ানো মারমুখী তরুণকে বন্দুকের ভারী অংশটা দিয়ে আঘাত করল একজন।
'সরে যা ইতরের দল।'
মাথায় রক্ত নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ছেলেটা। তার অবস্থা দেখে ভিড়ের মধ্যে থেকে চিৎকার করে উঠল কেউ। আবার বন্দুকের গর্জন হতেই যেটুকু মৃদু গুঞ্জন ছিল, তাও থেমে গেল। কেউ একজন মাটি থেকে পিটারকে তুলে ধরল। দূর থেকে তখন জন হোয়াইটের হুঙ্কার কানে আসছে, 'এত বড়ো সাহস তোদের! গোটা গ্রাম আমি জ্বালিয়ে দেব। কাউকে রেয়াত করব না। সব কটাকে কুকুরের মতো গুলি করে মারব।'
তাকে ধরে রাখা উর্দিধারীকে ঠেলে সরিয়ে দিল পিটার। ছিঁড়ে যাওয়া ধুলোমাখা নি-লেন্থ কোটখানা তুলেও আবার ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে। ঠোঁটের কষ ফেটে বেরিয়ে আসা রক্ত জামার হাতায় মুছে নিল। তারপর হুঙ্কার দিতে থাকা ইয়র্ক সিটির প্রভুর উদ্দেশে ইস্পাত কঠিন গলায় বলল, 'রক্তের ঋণ মি. হোয়াইট, রক্ত দিয়েই কি শোধ করতে হয়?'
শশব্যস্ত সুরে প্রত্যুত্তর দিলেন স্থূলকায় মানুষটি, 'ওদের তাই করতে হবে স্যার পিটার। নিশ্চিন্ত থাকুন আপনি। একটাকেও আমি ছাড়ব না।'
পিটার ক্যারেজের পা-দানিতে ভর দিয়ে ধনী বণিকের চোখে চোখ রাখল।
'তার আগে আমার কিছু জানার আছে মি. হোয়াইট। এই গ্রামের একটি মেয়ে মারা গেছে। আইয়ানা। আপনার প্রাসাদেও মাঝেমধ্যে কাজে যেত। চেনেন নিশ্চয়ই?'
বাকি কথাগুলো পিটারকে আর জিজ্ঞেস করতে হলো না।
'ওই ইতর চরিত্রহীন মেয়েটা? অবশ্য এদের আবার চরিত্র! বেজন্মার দল সব। বিছানা হোক বা জঙ্গল, শুতে পারলেই হলো। জেমস টাউনের ভাঙা দুর্গে কারোর সঙ্গে ফুর্তি করতে গিয়েছিল মনে হয়। দলে অনেকজন ছিল। ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলে গেছে। বর্বরের দল আর কি। কিছু মনে করবেন স্যার পিটার, আপনার মতো সজ্জনের এই অসভ্যগুলোর সঙ্গে বেশি মাখামাখি করা অনুচিত। একেবারেই মানায় না।'
পিটারের দৃষ্টির ধার ক্রমশ বাড়ছিল। বুকের ভেতর একটা আগুনের কুণ্ডলী পাক দিয়ে উঠছে। পা-দানি থেকে আবার মাটিতে পা রাখল সে।
'ঠিক বলেছেন মি. হোয়াইট। ভুলটা আমারই। সংশোধন আমাকেই করতে হবে।'
কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই পিটার সবাইকে পেছনে ফেলে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল। হতচকিত জন হোয়াইট প্রথমটায় কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। তারপর গাছেদের আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকা ভার্জিনিয়ার কালেক্টরকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে উঠলেন, 'স্যার পিটার। স্যার পিটার ফিরে আসুন। ফিরে আসুন দয়া করে।'
জবাবে গাছেদের ছায়া ছায়া অন্ধকার ফুঁড়ে জবাব ভেসে এল, 'রক্তঋণ... রক্তঋণ... রক্তঋণ।'
উন্মাদ হয়ে গেছে।'
ধনী বণিকপ্রবর বিরক্তিভরে বলে উঠলেন। তারপর সঙ্গের সেপাইদের নির্দেশ দিলেন, 'শিগগিরই যাও। ধরে নিয়ে এসো পাগলটাকে। কিছু হয়ে গেলে গভর্নরের কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। যাও।'
বন্ধুকধারী একজন, সহজ নিশানা অভ্যাসের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় জিজ্ঞেস করল, 'আর এদের কী হবে স্যার?'
ক্যারেজ থেকেই লাথি ছুঁড়লেন জন হোয়াইট। দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বললেন, 'ছোটোলোকগুলো যাবে কোথায়? এখানেই পচবে। আগে যাও, স্যার পিটারকে দেখ। শেয়াল কুকুরে খেয়ে না ফেলে। তা হলে সর্বনাশ হবে। যাও গর্দভের দল।'
জন হোয়াইট তখনো জানতেন না, সর্বনাশের আগুন তাঁকেও পুড়িয়ে মারতে চলছে। নতুন করে বিদ্রোহের আঁচ লাগতে চলেছে এই উপনিবেশের গায়ে। ব্রিটিশ অহংকারকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে চলেছে মশাল ধরা একটা হাত।
রাতের অন্ধকার পুরোপুরি ক্ষয়ে যাওয়ার আগে, সেই আগুনের ছোঁয়ায় লাল হয়ে উঠল ইয়র্ক সিটির আকাশ। সকলে অবাক চোখে দেখল লকলকে শিখা গিলে নিচ্ছে গুদামঘর। দস্যি বাতাস তাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আরও। পরপর জ্বলছে তামাক বোঝাই ঘরগুলো! কটু গন্ধে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে ক্রমশ। সেই নাচতে থাকা সর্বগ্রাসী আগুনে জঙ্গলের সামনে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক অকুতোভয় শ্বেতাঙ্গ। পরনে মলিন সাদা জামা। ডান হাতে ধরা রয়েছে মশাল।
.............................
নষ্ট চাঁদের আলো
অলোক সান্যাল
............................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী , অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment