স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন।। জয়া মিত্র।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত জয়া মিত্রের উপন্যাস 'স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন' পড়ে লিখেছেন শর্মিষ্ঠা দাস। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.............................................
"১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে টেলিগ্রাফ কাগজে ব্যাঙ্গালোর থেকে সাংবাদিক জানকী নায়ারের করা একটা ছোট রিপোর্ট ছিল । উত্তর কর্ণাটকের দলিত জাতির একটি মেয়ে কিছুতেই দেবদাসী জীবন মেনে নিতে চায়নি, গনধর্ষণে খুন হয় সে । খবরে তার নাম উল্লিখিত ছিল স্বর্ণাভা বলে । একুশ বছর বয়স ছিল মেয়েটির " —মুখবন্ধের একদম প্রথমে এই খবরটি দিয়ে বই শুরু করছেন লেখিকা ।
সালটা ১৯৯৪ —যে বছর ঐশ্বর্য্য রাই বিশ্বসুন্দরী হলেন , যখন মুক্ত অর্থনীতি আর বিশ্বায়নের পথে হাঁটতে শুরু করেছে দেশ । সেই সময় এই দেশেরই একটা অঞ্চলে সব খবরের বাইরে নিদারুণ অবস্থায় দিনযাপন করে অন্ততঃ বারো হাজার দলিত মেয়ে ।
লেখিকা বরাবরের চরম সাহসিনী । অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেই তাঁর জীবন শুরু—সুতরাং তিনি যেভাবে ফিল্ড ওয়ার্ক করে বইটি লিখেছেন—একটা দলিল হয়ে রইল । যদিও কাল্পনিক সংলাপ ও ফিকশন স্টোরি ফর্মেই লেখা , কিন্তু বলিষ্ঠ বর্ণনা প্রমান করে যে বইটি যেন লেখা হয়েছে সংবাদ প্রতিবেদনের সততা , নিষ্ঠা , নিঁখুত ডিটেলিং সহযোগে ।
গল্প শুরুও যমুনা নামের এক সাংবাদিকের ট্রেন যাত্রা দিয়ে । যমুনা তাঁর পত্রিকার তরফে একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে দক্ষিণের এক শহরে যাচ্ছিল । সেই স্বর্ণাভার মৃত্যু নিয়ে পত্রিকার জন্য একটা স্টোরি । ক্রমশঃ নিজের পূর্বজীবনের কিছু অন্ধকার সময়ের সঙ্গে মিলে যায় তার এই গন্তব্য । পত্রিকার 'স্টোরি' র দায়বদ্ধতা ছাপিয়ে আরো অনেকদূর এগিয়ে যায় যমুনা । সে যাত্রাপথ শুধু সাংবাদিকের নয় , একজন সাহসিনী সত্যান্বেষীর !
সত্যঘটনা অবলম্বনে
কোনো উপন্যাসের ফিকশন অংশে যে আবেগ থাকে তার সঙ্গে তথ্যের সংযোগ ঘটানো খুব কঠিন । অধিকাংশ সময়েই প্রকৃত তথ্য দিতে গেলে তা যেন চরিত্রের মুখে জোর করে আরোপিত --এটা বেশ ধরা পড়ে যায় । "স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন "-এ লেখিকা জয়া মিত্র নিপুণভাবে সেই কঠিন কাজটি করেছেন । এ বই না পড়লে কোনদিন কি জানা যেত ? যে , নব্বুইয়ের দশক পর্যন্ত উত্তর কর্ণাটকের দশটি জেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় বারো হাজার "দেবদাসী" পরিবার ছিল অপ্রকাশ্য ভাবে ! কি বীভৎস প্রথার শিকার হয়ে? দেবদাসীদের দেবী ইয়েলাম্মা । তাকে ঘিরে এক ইয়েলাম্মা সংস্কৃতি ! উঁচুজাতের যৌন লালসার শিকার ছিল অভাবতাড়িত দলিত মেয়েরা --তাদের পরিবারই শৈশব পেরোলেই কন্যাকে তুলে দিত ওই ভয়ানক প্রথার হাতে ।
যে উঁচু জাতের পুরুষ রাতে ওই মেয়েদের ভোগ করত—দিনে জলের অভাবে তেষ্টায় ছাতি ফেটে গেলেও তাদের কাদা ছেঁচা জল খেতে হত , উঁচুজাতের পুকুর বা কুয়োর জলে তাদের কোনো অধিকার ছিল না । স্বর্ণাভা প্রশ্ন তুলেছিল এসবের বিরুদ্ধে ।
ওই সব গ্রামের কদর্য নিয়ম , জীবনযাপন , আর্থসামাজিক অবস্থা , জলকষ্ট , খিদে সহ্যের কষ্ট , রাজনীতির প্রতারণা , দুর্নীতি --সবকিছু পরতে পরতে তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে । বেশ কিছু কন্নড় শব্দের ব্যবহারে এমন এক আবহ তৈরি হয়েছে যা পাঠককে সরাসরি সব প্রত্যক্ষ করার অনুভূতি দেয় । ১৯৯৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত
লেখিকা বার বার গিয়েছেন উত্তর কর্ণাটকে , স্থানীয় সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে অনেক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন । নিজে ঘুরে ঘুরে জেনেছেন গলায় লাল পুঁতি , সাদা পুঁতি অথবা সাদা লাল পুঁতির মালা পরা মেয়েরা কে কোন গোত্রীয় দেবদাসী —কার কপালে কত বেশি দুঃখ । কন্নড় বন্ধুর কাছ থেকে শিখেছেন অনেক কন্নড় প্রতিশব্দ ।
'দেবদাসী' কথাটার মধ্যে যে এক মায়াবী নৃত্যের মুদ্রা , এক স্বর্গীয় বিভঙ্গ আছে—এ বই পড়লে জানা যাবে শব্দের ওপারের অন্ধকার গল্প । এই প্রথা থেকে বেরিয়ে অঙ্গনওয়াড়ি কাজ করে বাঁচতে চেয়েছিল স্বর্ণাভা —তাঁর মৃত্যু ভয়ঙ্কর —আরো ভয়ঙ্কর অনেক স্বর্ণাভার জীবন । সরকারি কাগজে কলমে অনেকদিন আগেই , হয়তো এতদিনে সত্যি দেবদাসী প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে । তবু, এ বইটি শুধু নিছক ফিকশন নয় , আরামদায়ক প্রেম বিরহ বা সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প নয়— তার বাইরেও অনেক কথা বলে। কুর্নিশ জানাই লেখিকার সাহস ও নিষ্ঠাকে।
স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন
জয়া মিত্র
সুপ্রকাশ
মূল্য ২৫০ টাকা
Comments
Post a Comment