মেস-হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় তারাশঙ্কর থাকতেন এন্টালি অঞ্চলে। পরে কিছুদিন ছিলেন বউবাজারের একটি মেস-এ। এন্টালিতে বহু অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বসবাস। এই মেস বাড়িটির একটি পরিত্যক্ত ঘরে দুই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান মহিলা বাস করতেন। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। খ্রিস্ট-ধর্মাবলম্বী ভারতীয় সম্প্রদায়কে তারাশঙ্কর যেটুকু দেখেছিলেন, সেখান থেকেই পরবর্তীকালে গড়ে তুলেছেন 'সপ্তপদী' (১৯৫৭) উপন্যাস।
১৯৩৩ সালে মনোহরপুকুর সেকেন্ড লেনে একটি পাকা-দেওয়াল টিনের-ছাউনির ঘর ভাড়া করেন তারাশঙ্কর। চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, এই বাড়িটির ঠিকানা ছিল : পি-৬২৩, মনোহরপুকুর সেকেন্ড লেন, পো কালীঘাট। এখানে ঘরভাড়া পাঁচ টাকা। লাইট-চার্জ এক টাকা। চা-জলখাবার সাত-আট টাকা। খাবার খরচ আট টাকা। এই বাড়িতে কল-চৌবাচ্চা ছিল না. একটা টিনের গোল জালা কিনেছিলেন তিনি। ভোরবেলা কলে জল এলেই বালতি করে রাস্তার কল থেকে জল এনে জালাটা ভর্তি করে রাখতেন। তার আগেই ঘর পরিষ্কার, জল দিয়ে মোছা শেষ হতো। আসবাবপত্র কিছু ছিল না, একটা দেওয়ালের তাকে সামান্য জিনিস থাকত। মেঝের উপর শতরঞ্চি পেতে, সুটকেস টেনে, সেটিকেই রাইটিং ডেস্ক হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিছুদিন পর আলিপুর আদালতের কাছে পুরোনো আসবাবের দোকান থেকে একটা কুশন-মোড়া আধ-সোফা ও একটা ফোল্ডিং চেয়ার কিনেছিলেন। বিকেলবেলা ফোল্ডিং চেয়ারটা বের করে বাইরে গলি-রাস্তায় পেতে বসে আরাম করতেন। বিড়ি টানতেন। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ছিল আরও বিচিত্র। ওখান থেকে রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ের মোড়ে যেতেন চা খেতে। দুপুর এবং রাতের আহারের ব্যবস্থা প্রথম মাসটা করেছিলেন তাঁর দেশের কয়েকটি ছেলের সঙ্গে। মনোরঞ্জন সরকার, বাদল, সুধীর আরও দু- তিনজন ভাগ্যান্বেষণে মহানির্বাণ রোড, অশ্বিনী দত্ত রোড এবং মনোহরপুকুর সেকেণ্ড লেনের সংযোগস্থলে কয়লার ডিপো খুলেছিল, তার সঙ্গে ছিল দুধের ব্যবসা, মুদিখানা। ওদেরই সঙ্গে মাসখানেক খাওয়াদাওয়া করেছিলেন, তারপর পাইস হোটেলে।
সকালবেলা গৃহকর্ম সেরে লিখতে বসতেন। বেলা বারোটা নাগাদ স্নান সেরে লেখা হাতে বেরিয়ে যে- কোনো পাইস হোটেলে খেয়ে নিয়ে কাগজের অফিসে হাজির হতেন। বেলা আড়াইটে-তিনটে নাগাদ প্রথম দিকে 'বঙ্গশ্রী' অফিসে, পরে সজনীকান্ত দাসের 'শনিবারের চিঠি'-র অফিসে এসে খান দুই-তিন চেয়ার জুড়ে তার উপর আধ ঘন্টা-পয়তাল্লিশ মিনিট ঘুমিয়ে নিতেন। বিকেল পাঁচটা-ছটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতেন। যেদিন ফিরতে রাত্রি হতো, সেদিন পথেই খাওয়া সেরে মেসে ফিরতেন।
তারাশঙ্কর এই মনোহরপুকুর সেকেন্ড লেনে ছিলেন প্রায় দেড় বছর।
তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু এখানেই। এই সময়েই লিখেছেন-শ্মশান-বৈরাগ্য, মধুমাস্টার, ঘাসের ফুল, জলসাঘর, রায়বাড়ি, আখড়াইয়ের দীঘি, তারিণী মাঝি-র মতো অনেকগুলি শ্রেষ্ঠ বিশ্বমানের গল্প। 'নটু মোক্তারের সওয়াল' নামে একটি গল্প এই সময় লেখা হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে 'দুই পুরুষ' নাটকে পূর্ণতা পায়। 'আগুন' উপন্যাসটিও এই ঘরে বসে লেখা। এইসব অসাধারণ মানের গল্পগুলির সঙ্গে বেশ কিছু চিঠিও এই ঘরে বসেই লেখা হয়েছিল। স্ত্রীকে লেখা এইসব চিঠি তারাশঙ্করের লেখকসত্তার উজ্জীবনের এক মূল্যবান দলিল।
এরপর তারাশঙ্কর উঠে যান বউবাজার স্ট্রীটের একটি মেসবাড়িতে। সেটা ১৯৩৫ সাল। বউবাজারের এই মেসটি ছিল একটি বিচিত্র স্থান। বাড়িটি ছিল কলেজ স্ট্রীট ও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর মধ্যে বউবাজার স্ট্রীটের উত্তর ফুটপাতের উপর। সামনেই একটি গীর্জা ছিল। উত্তর দিকে ফুটপাতের বাড়িটার ঠিক একটি বাড়ির পরেই ছিল 'ফিরিঙ্গি-কালীবাড়ি'। চিনেম্যান, দেশি ক্রীশ্চান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, মুসলমান—নানান জাতি, ধর্ম ও ভাষা নিয়ে পাড়াটা। শুধু তাই নয়, বড়ো বড়ো বাইজিদের বাসা এখানে। যে বাড়িটায় তাদের মেস ছিল, সেই বাড়িতে এককালে ছিল বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক 'সারভেন্ট' পত্রিকার অফিস। সেকথা জানিয়েছিলেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। একটা তিনতলা বাড়ি। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। নিচের তলায় চামড়ার গুদাম। সামনেটায় ফার্নিচারের দোকান। একটা গলিপথে ঢুকে পুবমুখী দরজার উপরতলায় সিঁড়ি। এই সিঁড়িটা বাড়িটিকে দু-ভাগে বিভক্ত করেছে। সামনের ভাগে দোতলা ও তিনতলায় চারটি বড়ো বড়ো ঘরে পশ্চিমদেশীয়া বাইজিরা থাকে। উত্তরে আটখানা ঘরে চারটি মেস। এক-এক ঘরে দশ-বারোজন করে থাকে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, বরিশাল, বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম—সবজায়গারই লোক। তারাশঙ্কর যে মেসটায় থাকতেন, সেই মেসটা ছিল লাভপুরের নির্মলশিববাবুদের [নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায় (১২৯১- ১৩৫১)। ইনি তারাশঙ্করের জন্মস্থান লাভপুরে নাট্যালয় স্থাপন করেছিলেন। সেকালের সুপরিচিত নাট্য-ব্যক্তিত্ব ছিলেন। 'রাতকানা', 'ভুলের খেলা', 'নবাবী আমল' ইত্যাদি নাটক ও নক্শা রচয়িতা। 'নাট্যবিদ্যাভারতী' ও 'কবিভূষণ' উপাধিপ্রাপ্ত—স.] ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের কর্মচারিদের মেস। কয়েক বছর পর অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে ওই মেস ছেড়ে দিলেন তারাশঙ্কর।
.
.
.
তারাশঙ্করের মেস-জীবন : সময় আর জীবনের জ্যামিতি
স্বরূপ বোস
………………………….
মেস-হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য : ৬৫০ টাকা
সুপ্রকাশ
পোস্টে ব্যবহৃত ছবি ঋণ : বর্ষণা
Comments
Post a Comment