অভিমানভূম।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।।
মানভূমের প্রকৃতি কোনো যুক্তিই খাড়া করতে দেয় না আবেগের উপরে। তাই পণ্ডিতরা যতই বলুন না কেন, মাঠের ধান ঘরে উঠলে কৃষি-নির্ভর পরিবারগুলোতে সমৃদ্ধির পরব 'টুসু' পালিত হয়, তবু এটা আসলে একদমই প্রান্তিক মেয়েদেরই উৎসব। তাই যেন তাদের টুসু গানে ধরা পড়ে যায় তাদের ভীষণ নিজস্ব সুখ-দুঃখের সাতকাহন। অনেকের মতে, টুসু আসলে মা লক্ষ্মীর লৌকিক রূপ, অর্থাৎ দেবী হলেও তিনি যেন একান্তই ঘরের মেয়ে, যার উপর রাগ করা যায়, চোখের কোল ঝাপসা করে অভিমান করা যায় মন ভরে। ঘরের মেয়ে, তাই তাঁর আরাধনায় আড়ম্বর নেই, বরং আন্তরিকতা আছে। আছে মেয়েদের গায়ে হলুদের সময় সখীদের খুনসুটিতে এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ার মতো সোহাগ।
সৃষ্টিধরবাবুর কথাতেই উঠে আসে অমোঘ উচ্চারণ একটা, ‘টুসুর কোনো জাত নেই, কোনো ধর্ম নেই, কোনো বর্ণ নেই, কোনো মন্ত্র নেই। সবাই টুসু মায়ের পুজো করতে পারে। টুসু গান গাইতে পারে। আর এই গানেই হলো টুসুর আসল মন্ত্র।' শুনতে শুনতে আশ্চর্য লাগে, একদিকে যখন এত হানাহানি কাটাকাটি কিংবা হেঁশেলে উঁকি দিয়ে দেখা কী ফুটছে উনুনে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রান্তিক এই উৎসবগুলো ঠিক কতটা আধুনিক হয়েই শুরু করেছে সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে তার পথচলা। অথচ তবু আমাদের নাগাল এড়িয়ে প্রচলিত মূলধারার বাইরেই রয়ে গেছে এইসব উদযাপন কত-কতদিন!
তাই পৌষ মাসের সংক্রান্তি, অর্থাৎ মকর সংক্রান্তির দিনে পুরুলিয়া বা বাঁকুড়া গেলে, শহুরে উৎসবের ভিড়ে অভ্যস্ত চোখে ধাক্কা লাগতে বাধ্য। কাতারে কাতারে মানুষ, যাদের সারাটা বছর কাটে মাঠে ঘাটে ক্ষেতের কাজে, ইট ভাঁটায়, কিংবা অন্য রাজ্যে বা অন্য জেলায় মজুর-মিস্ত্রি বা জোগারীর কাজে, তারা হাতে রঙিন চৌডল নিয়ে চলেছে গান গাইতে গাইতে। মুখে দেশি নেশার গন্ধ ভুরভুর। তাদের নাচে-গানে-আনন্দে সেই নেশা যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে কাসাই নদীর দু'পায় জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সোহাগী বালিতে, কুমারী নদীর আদরে অথবা শিলাবতীর তিরতিরে হিল্লোলে। খোলা আকাশের নীচে মানুষের এই রকম মন খুলে আনন্দ করার কারণ, সারা মাস ধরে চলা টুসু পরবের মধ্যমণি টুসু মায়ের বিদায়ের দিন সেদিন। সেদিন টুসু ভাসান!
অভিমানভূম
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment