শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস পড়ে লিখেছেন স্বপ্না রায়। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।।
.
.
.
'শেষ মৃত পাখি' হাতে নিয়ে কাজকর্ম সব চুলোয় গেল। কেউ মাথার দিব্যি দেয় নি। দেওয়ার কথাও নয়। দুটো কথা না বলে পারলাম না যে। এমন মনোযোগ সহকারে হালফিলের কোন লেখা পড়েছি বলতে পারব না। প্রায় দু'দশকের ছোটো এই লেখকের লেখা আগেও পড়েছি 'আরেক রকম' পত্রিকায় কিংবা অন্যত্র। সর্বত্রই মেধা-মননের উপস্থিতি।  লেখার ধার অনুভব করেছি। ভালো লাগে নবীন লেখকদের এই সগৌরবে পদচারণা।

 'শেষ মৃত পাখি' আমায় ভাবিয়েছে। দার্জিলিং এর প্রেক্ষাভূমিতে নির্মিত এ উপন্যাসের কারুকৃৎ মনকে ছুঁয়ে যায়। বৃষ্টিভেজা দার্জিলিংয়ের ভিন্ন সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রহস্যের জট খুলতে খুলতে শরীর  ভেঙে পড়লেও মনের ছিলাকে টান টান করে রাখা তনয়া নামের সাংবাদিককে কুর্নিশ জানাবার সুযোগ করে দিলেন যে তরুণ লেখক শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য তাঁকে নতুন করে চিনলাম। তিনি যে একটি রহস্যোপন্যাস লিখবেন বলেই লিখলেন এমনটি আমার মনে হল না। অমিতাভ মিত্রের হত্যাকে কেন্দ্র  করে অরুণ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়ে যে স্টোরি তৈরি করার আয়োজন চলছিল তা আমাদের নিয়ে যায় আরও অনেক গভীরে। শাসনব্যবস্থা এবং সমাজ-অর্থনীতির বৈষম্য নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।  অবশ্যই রাজনীতিসংপৃক্ত জীবনের কথাও। 

উত্তরবঙ্গের বিশেষ অঞ্চলটিকে বোধহয় হাতের তালুর মতো চেনা তাঁর। ছবির পর ছবি ভেসে উঠেছে। দেখতে পাচ্ছি জলাপাহাড়ের রাস্তায় পাইপ মুখে নিয়ে হেঁটে চলেছেন ড্যানিয়েল নাকি অরুণ। জিপে চড়ে ঘুরে বেড়ানো ড্যানিয়েল ?  অনন্যা , সিদ্ধার্থ , আনন্দ পাঠক , বিনয়েন্দ্র মুস্তাফি , গিরিরাজ, রামবীরের কথা বলতে ইচ্ছে করে। ধনরাজ গম্বুর কথা বললে আর একটি নিবন্ধ তৈরি হয়ে যেতে পারে। সঞ্জয়ের কথা নাই বা বললাম।  নকশালদমনপীড়নের কথাও বলছি না যার সূত্রে তৈরি হয়ে যাচ্ছে উপন্যাসের বিষয় । বরং বলি মানুষের মনোগহনের টানাপোড়েনের দিকগুলোর কথা। যা কুরে খেয়েছে অরুণকে , ড্যানিয়েলকে। এঁদের সঙ্গে থাকা মানুষজনকেও। আর বাবলা?

লিখনশৈলীর সজীবতা আনন্দ দিয়েছে। টু ইন ওয়ান পেতে কার না ভালো লাগে। একটি উপন্যাসের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা আর একটি উপন্যাস প্রায় ফ্রিতে মিলে গেছে। একটি রহস্যকাহিনি থেকে আর একটিতে পৌঁছে যাওয়া। সে উপন্যাসের রচয়িতার পরিচয়টি জেনে  একেবারে ভিতর থেকে চমক লাগে। তবু আমার মনে হয়েছে একমাত্র এই অংশটির কারণে  উপন্যাসে কিছুটা দুর্বলতা এসেছে। নিতান্তই ব্যক্তিগত অভিমত । সব মিলিয়ে বড্ড ভালো লেগেছে। বিশেষত শেষের দিকে ৩৩০ পাতা থেকে যখন অরুণ বলতে শুরু করেছেন , অনন্য রায়ের কবিতা যে অংশের সূচনায় তা এককথায় সুপার্ব। কেউ যদি এই অংশটিতে হঠাৎই চোখ বুলিয়ে নেন তক্ষুণি শাক্যজিতের মুন্সিয়ানায় মুগ্ধ হবেন।

ওহ্ ! বলাই হল না যে মূলতঃ একটি বিশেষ সময়ের কবিদের কবিতা যেভাবে ব্যবহার করেছেন লেখক,  সেকথা না বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। কবিতা দিয়ে মোড়া এমন রহস্যোপন্যাস বাংলা সাহিত্যে  আর কটি আছে।  মৃদুল দাশগুপ্ত,  প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু রক্ষিত, বীতশোক ভট্টাচার্য, নবারুণ ভট্টাচার্যরা যেভাবে এসেছেন তা কবিতার ভুবনে শাক্যজিতের অধিবাসকে স্পষ্ট  করে।  উত্তাল  সত্তরে উত্তরবঙ্গের কবিদের সক্রিয়তাকে চিনিয়েছেন। প্রসঙ্গত এসেছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের নাম। এসেছে প্রিয় মানুষ অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের নামটিও। এমনটি মনে হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে অঙ্গনেও তাঁর নিঃসঙ্কোচ পরিক্রমা।  শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য আরও ভালো লেখা আমাদের উপহার দেবেন। 'শেষ মৃত পাখি'র পাঠপ্রতিক্রিয়া এমনটিই। শুধু জানতে ইচ্ছে করে কোনো এক সময় তিনি আমাদের বেহালার চড়কতলা- কালিতলা বা তৎসন্নিহিত কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন কিনা। না হলে তাঁর লেখায় গদাইবুড়ির মাঠ উঠে আসে কেমন করে ! 



▪শেষ মৃত পাখি
▪শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য 
▪প্রচ্ছদ: সৌজন্য চক্রবর্তী
▪মুদ্রিত মূল্য : ৫২০ টাকা
▪সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।