শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস পড়ে লিখেছেন শাহলুল তানজিম। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।।
.
.

‘পৃথিবীর সবথেকে বুদ্ধিমান এবং নিখুঁত খু*নি হিসেবে তুমি কাউকেই দাগিয়ে দিতে পারবে না। সহজ কারণ। যে খু*নটা নিখুঁত হবে, তার খু*নি হিসেবে তুমি কাউকে শনাক্ত করতে পারবে না। ভাববে আত্মহ*ত্যা, বা অ্যাক্সিডেন্ট। আর শনাক্ত করলে, সেটা নিখুঁত হবে না।’

এ কয়েকটা লাইনই যথেষ্ট একজন থ্রিলারপ্রেমীকে গল্পে আটকে ফেলতে। মানে পারফেক্ট মা*র্ডার নিয়ে এভাবে তো ভেবে দেখিনি। তাই এ লাইনগুলো আপনাকে আটকাতে পেরেছে কিনা জানিনা, আমাকে আটকে ফেলেছিলো। আর এই লাইনগুলো আছে শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের রহসোপন্যাস ‘শেষ মৃত পাখি’র একদম ১ম পৃষ্ঠায়।

বেশ অনেকদিন বাদে বইয়ের রিভিউ লিখছি। বেশ অনেকদিন বাদে হবার জন্য অনেক কারণ আছে আর তাছাড়া ইদানিং রিভিউ লিখতেও আলসেমী লাগে। যাই হোক ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে কাজ নেই, স্রেফ এক লাইনে বলি। এত আলসেমী, ব্যস্ততা সত্ত্বেও ‘শেষ মৃত পাখি’র রিভিউ লিখতে বসার একটাই কারণ, সেটা হচ্ছে একজন পাঠক হিসেবে আরেকজন পাঠকের কাছে ভালো বইয়ের (অনন্ত আমার কাছে ভালো) খবর পৌঁছে দেয়ার দায়।

গল্পটা শুরু হয় ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট তনয়া ভট্টাচার্যের দার্জিলিং যাত্রা দিয়ে। তনয়া সারা ভারত ব্যাপি যত অমীমাংসিত কেস রয়েছে তা নিয়ে একটি ধারাবাহিক লেখেন ম্যাগাজিনে। ধারাবাহিকটা বেশ জনপ্রিয়। আর সে জনপ্রিয় সিরিজের শেষ লেখাটি হবে ৪৪ বছর আগে দার্জিলিং এর বুকে ঘটে যাওয়া ৭০ দশকের উঠতি সম্ভাবনাময় কবি অমিতাভ মিত্রের খু*নের রহস্য উদঘাটন দিয়ে। এ খু*নের সবচাইতে সন্দেহভাজন ব্যক্তি একজন বিখ্যাত লেখক, অমিতাভ মিত্রের বন্ধু অরুণ চৌধুরী। কিন্তু অভিযোগের তীর তার দিকে থাকলেও ৪৪ বছর আগেও সে তীর মুখ থুবড়ে পড়েছিলো। অরুণ চৌধুরীর শক্ত অ্যালিবাই থাকার এবং যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে। তবে কি আসলে অরুণ চৌধুরীই খু*নি নাকি এই প্রায় পারফেক্ট ক্রাইমটির পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোন রহস্য? অরুণ যদি খু*নী না-ই হোন তবে খু*নী কে? ৪৪ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। সময় নদীর স্রোতে গত হয়েছেন ঘটনার অনেক পাত্র পাত্রীই, হারিয়ে গেছে অনেক সূত্রই। তার থেকে বড় কথা হচ্ছে, ৪৪ বছর আগে যে রহস্য কেউ সমাধান করতে পারেনি, আজ এত বছর পর তনয়া কি পারবেন ইতিহাস খুঁড়ে সে রহস্য উদ্ঘাটন করতে?

এই হচ্ছে উপন্যাসের মূল কাহিনী। তবে এত ছোটভাবে বললেও উপন্যাসটা যে মোটেও এত ছোট কিছু না সেটা পাঠকগণ উপন্যাসের সাইজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন (৪০৪ পৃষ্ঠা)। এবারে বলি বইটা আমার কেমন লাগলো আর এইটুকু গল্প লিখতে লেখকের কেন ৪০০+ পৃষ্ঠা লাগলো।

বইটাকে স্রেফ মার্ডা*র মিস্ট্রি কিংবা রহস্যপোন্যাস বললে এটার প্রতি অবিচার করা হবে। কারণ একটিই, লিখনশৈলী। তবে লিখনশৈলী নিয়ে বলার আগে অন্য জিনিসগুলো নিয়ে বলি।

প্লট বিচারে এই বইয়ের প্লট অনন্য। আমি প্লট হিসেবে যেটাকে লিখেছি সেটার চাইতে অনেক বেশী বিস্তৃত। তবে সেটা বলে দিয়ে আপনাকে উপন্যাসটার স্বাদ থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। তবে যারা স্রেফ প্লট/কন্টেন্টের বিচারে পড়েন তাদের জন্য এ বই একদম পারফেক্ট একটা উপন্যাস। সেই সাথে মেজর দুটো টুইস্ট আছে, যেগুলোর প্রথমটি অনেকে ধরতে পারলেও শেষটি আপনি ধরতে পারবেন না, আমি মোটামুটি নিশ্চিত, যদিও অসংখ্য ক্লু বইয়ের ভেতরের পরতে পরতে ছড়ানো ছিলো। সুতরাং টুইস্ট লাভাররাও বইটা তুলে নিতে পারেন স্বচ্ছন্দ্যে। চাইলে উপন্যাসের মূল রহস্য উদ্ঘাটনকে আপনি চ্যালেঞ্জ হিসেবেও নিতে পারেন।

এরপর আসে চরিত্রায়ন। আমার দৃষ্টিতে এইখানে লেখক পুরোই ছক্কা হাঁকিয়েছেন। মানে প্রতিটা চরিত্র আমার কাছে আলাদা লেগেছে। লেখক অনেক যত্ন নিয়ে তৈরী করেছেন বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে অমিতাভ চরিত্রটা। তাকে বর্ণনা করার অংশগুলোয় পাগলাটে, ক্ষ্যাপা একটা মানুষের ছবি দেখেছি যে কিনা শুরুতে কবিতার ফুলঝুরিতে সমাজকে পাল্টে দেবার ইচ্ছাপোষণ করতো। তার লেখা চিঠিগুলোতেও তার চরিত্রের দিকগুলো দারুণভাবে উঠে এসেছে। উপন্যাসে আরেকটা এক্সক্লুসিভ ব্যাপার আছে। সেটা হচ্ছে, বইয়ের মাঝে বই। এখানে অমিতাভের একটা অর্ধসমাপ্ত উপন্যাস আনা হয়েছে যেটা অরুণ চৌধুরী তনয়াকে দেন পড়ার জন্য। অরুণ চৌধুরীর মতে এখানে অমিতাভের মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। এই যে উপন্যাসের মধ্যে উপন্যাস, এই কনসেপ্টটা আমার দারুণ লেগেছে। আর তাছাড়া এই উপন্যাসে যে চরিত্রগুলোও এসেছে ওগুলোও অনেক যত্ন নিয়ে তৈরী করেছেন লেখক।

আর পাঁচটা থ্রিলার বইয়ের মত নয় এ বইয়ের লেখা। এ বইতে এসেছে ৭০ দশকের সাহিত্য, রাজনীতি, লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যে তার প্রভাব, লিটল ম্যাগাজিন আর ব্যবসায়িক প্রকাশনী গুলোর দ্বন্দ্ব। আরও এসেছে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল আন্দোলন। শুধু তাই নয়, গল্পের প্রয়োজনে এসেছেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (বইটার নামও কিন্তু তার কবিতা থেকেই নেয়া হয়েছে), শম্ভু রক্ষিত, প্রসূন বন্দোপাধ্যায়সহ আরো অনেক কবি। লেখক শাক্যজিৎ শুধু একটি রহস্যপোন্যাস লিখতে চাননি। এমনকি আমি মনে করি এটি আসলে রহস্যপোন্যাস কম, মূলধারার সাহিত্য বেশি। কি দারুণ ভাষার প্রয়োগ, কি দারুণ শব্দের ব্যবহার! আমি তো অন্তত ১০টা নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছি। সাথে দারুণ কিছু দার্শনিক উক্তি যেন উপরি পাওনা ছিলো। এই মূহূর্তে একটা সেরা উক্তির কথা মনে পড়ছে-

“খু*ন হল একটা শিল্প। আর গোয়েন্দা হল সেই শিল্পের ক্রিটিক। সমালোচক যেমন শিল্পকর্মের ভেতর থেকে লুকানো নানা চিহ্ন খুঁজে খুঁজে ব্যাখ্যা করেন, গোয়েন্দাও একটা হ*ত্যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন ক্লু খুঁজে খুঁজে হ*ত্যার ব্যাখ্যা দেয়।”

কি দারুণ উক্তি, তাইনা? এছাড়াও গল্পের প্রয়োজনে এসেছে অনেক নামী দামী কবির কবিতা, ৪০-৪৫ টা তো হবেই। আর এই কবিতার জন্যই এখানে একটা পাঠকদের উদ্দেশ্যে একটা সতর্কবার্তা দেয়া প্রয়োজন মনে হলো। আপনি যদি স্রেফ একটা স্ট্রেইট থ্রিলার পড়তে চান, যেখানে শুধু রহস্য ও রহস্য উদ্ঘাটন নিয়ে কথা হবে, তাহলে এই বইটা আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। তবে যদি রহস্যের সাথে সাথে সেই সময়ের পটভূমি নিয়ে জানতে চান, দার্জিলিং এর গ্লুমি আবহাওয়ায় দূর্দান্ত বর্ণনা উপভোগ করেন তবে এই বইটি আপনার জন্যই।

বইয়ের কি সবই ভালো দিক? আসলে সব দিকই ভালো এমন বই খুব একটা হয় না। প্রায় পারফেক্ট এই বইটার একটা দিক আমার খানিকটা দূর্বল লেগেছে। তবে সেটা আসলে আমারই দূর্বল লাগবে, আপনার নাও লাগতে পারে তাই রিভিউতে উল্লেখ করলাম না। আপনি যদি বইটা পড়তে চান কিংবা বইটা ইতোমধ্যে পড়ে থাকেন স্রেফ তাহলেই আপনার সাথে ইনবক্সে এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এখানে নয়, কারণ দূর্বল জায়গাটা হোয়াইট বা ব্ল্যাক না, গ্রে। আর সেটা বলে আপনার বই পড়ার আগ্রহটা নষ্ট করতে চাই না। এমনকি বইটা এ জায়গাটাকে কোট করা সম্ভবত ডিজার্ভও করে না (খানিকটা বায়াসড মনে হচ্ছে, না?)। তারচেয়ে বরং বইতে ব্যবহৃত হওয়া পছন্দের একটা কবিতা দিয়ে রিভিউটা শেষ করি, কেমন?

Yesterday, upon the stair,
I met a man who wasn't there!
He wasn't there again today,
Oh how I wish he'd go away!

পুনশ্চ : এই কবিতাটার মাঝে কিন্তু বইতে লুকিয়ে থাকা রহস্যের খানিকটা আছে। ক্লু দিলাম। বই পড়ার সময় কাজে লাগাতে পারেন কিনা দেখেন।
ফটোক্রেডিট : অর্ক (ফেসবুক থেকে পাওয়া)


▪শেষ মৃত পাখি
▪শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য 
▪প্রচ্ছদ: সৌজন্য চক্রবর্তী
▪মুদ্রিত মূল্য : ৫২০ টাকা
▪সুপ্রকাশ 


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।