অভিমানভূম।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।।
দক্ষিণের পর্বতের থেকে না এলেও, মানভূমের পাহাড়ি ঝোড়াগুলোরও পাগলামি কম কী! আর সেসবের সামনে দাঁড়ালেই মনে হয়, নিয়ম কখনও শিকল হয়ে গেলেই, সেটা যতটা না ভয়ের, তার থেকেও বেশি একঘেয়ে। যেমন, উৎসবের এই এত এত আঙ্গিক, তার পিছনে চলমান ইতিহাস, সেসব সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে শুধুই কেমন একটা দেখনদারি নিয়ে থেকে গেল শহুরে উৎসবগুলো আমাদের। আনন্দগুলো আটকে গেল গ্লাসে আর চিৎকারে অকারণ। ভীষণ চাকচিক্য নিয়েও থেকে গেল কেমন মধ্যবিত্ত হয়েই। অথচ ভিন্নমতকে শোনার বা মেনে নেওয়ার জন্য যে ধৈর্য বা মনটা, সেটা যেন এসবের ভিড়ে হাত ছাড়িয়ে হারিয়ে গেল কোথায়। অসুরেরও যে পুজো হতে পারে, সেটা সামনে আনার চেষ্টা করতেই তাই একরাশ অনভিপ্রেত অশান্তি। এসব থেকে তাই আবার পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে গভীর রাতের হ্যাজাক এবং গ্যাস বাতির সাদা আলোর মধ্যে ধুলো ওড়া মাঠে। শুধুই ধর্মকথা বা বীরগাথা নয়, বরং সেই সব উদযাপনের কাছে, যারা তার বুকের ভিতর মিশিয়ে নিতে শিখে যায় জীবনের ছোট বা বড় আনন্দ দুঃখ আশা এবং নিরাশার আলো-ছায়াগুলোকেও।
পার হয়ে যায় অক্টোবরও। পুরুলিয়াতে এসে নামি আবার ‘একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায় / যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে'। আবার একটা কালীপুজোর দিন। ঝলকে ফিরে আসে সেই কোন কালে প্রথমবার এই মানভূমিতে পা রাখার স্মৃতি, এই দিনেই। গ্রীষ্মের দহন নেই; শীতের জড়তা নেই। সন্ধেগুলোর তাড়াহুড়ো লেগে যায় রাত্রির কোলে মাথা লুকানোর জন্য। কলকাতা বসে এই মানভূমের প্রকৃতির আঁচ করা খুব মুশকিল। ছ'টা ঋতুই ভীষণ স্পষ্ট যেখানে। ভীষণ স্পষ্ট পাতাঝরার মরশুম।
এবার আর মলয়দাকে ডাকা হয়নি গাড়ি নিয়ে আসার জন্য। সঙ্গে ব্যাগপত্র কম। আগেরবারে রেখে যাওয়া হয়েছিল অনেককিছুই। তবু পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে ভোরের বাসে পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরের গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে, ঠাণ্ডা হাওয়াটা বশে নিয়ে নেয় মাথা-কপাল সবটাই। অগত্যা বিকেল পেরোতে না পেরোতেই, বেশ কিছুদিন পর আবার সেই জঘন্য মাথার ব্যথাটা কমিউনিটি রেডিয়ো স্টেশন থেকে বের করে দিয়ে ঘরের পথ ধরিয়ে দেয় তাড়াতাড়ি। ফেরার পথে মাথা ব্যথা কমাতে দাঁড়াতেই হয় চায়ের দোকানে।
হঠাৎ কোথা থেকে ইমন এসে হাজির। প্রায় আমারই সমবয়সী অথবা দু- এক বছরের এদিক-ওদিক হবে ইমন, যার ভালো নাম ইমন কল্যান। ওর সঙ্গেই কাজের পর মাঝেমধ্যে মাঠে পাথরের উপর ঠান্ডা বোতল নিয়ে বসা আমাদের এবং ওই প্রত্যন্ত গ্রামের অতি সাধারণ একটা রেডিয়ো স্টুডিয়োতে বসে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রোডাকশন করে চমকে দেয় যে। আর মাঝেমাঝেই মেজাজে থাকলে, অদ্ভুত ডায়লগ দেয় একটা, 'শুনো, তুমি আমারই বয়সের হবে। তাও তোমাকে দাদা বলি। কিন্তু কাজের পর মাঝে মাঝে তোমাকে নাম ধরে ডাকব...' এইসব কালজয়ী বক্তব্যের পর ‘পোকার ফেস' করে স্লো ক্ল্যাপ দেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। কিন্তু তখন এসব কায়দা কোথায়! তা স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে প্রায় 'আগুন গরম' চা গলায় ঢেলেও যখন মাথা ব্যথা কমেনি, বুঝতে পারছি আজকে ভোগান্তি চরমে, তখনই ইমন বাইক নিয়ে একদম গা ঘেঁষে, 'ঘর চইললো?'
এমনই মাথা ধরেছে, দশ-বারো মিনিটের হাঁটা পথই যেন দশ-বারো মাইল। ফেরেস্তা ইমনের বাইকে উঠে পড়া গেল। একটু বাজারের দিকে যেতে হবে। কয়েকটা ওষুধ নেওয়ার আছে।
বাজার যাওয়ার পথে দু'পাশে ছোট ছোট চাষ জমি, নীচু পুকুর, ছোট ছোট ঘর-বাড়ি। মাটির দেওয়াল। খোলা মাঠের মধ্যে বাৎসরিক যাত্রাপালার জন্য একটা বাঁধানো স্টেজ। হাওয়ার ঝাপটা এড়াতে অনুরোধ, 'একটু আস্তে চালিও!' অনুরোধের আর্জি মান্যতা পাওয়ায় ধীরেই উড়ছে দু'চাকা! বাইকের পিছনে খেয়াল করে ডাক দিচ্ছে কেউ কেউ, 'আজ আসা হইলা?' মাথা নেড়ে যাচ্ছি, তখনই ইমন বলল, 'এবার একটু ইস্পিড নিই, নাকি?' আর ঠিক তখনই হঠাৎ একটা পুকুরের পাড়ে নেমে যাওয়া ঢালের ঘাস জমিতে ওদের সঙ্গে দেখা। এক ঝাঁক কচিকাঁচা। কিছু একটা কাঠামো তৈরি করেছে নিজেরাই। উপাদান বলতে কাঠ, খড়, নারকোল বা সুপারি পাতা। কাঠামোর আবার মাথা মোট তিনটে! বেশ কোলাহল। কিন্তু উন্নয়ন বা প্রযুক্তির গতিবেগ ছোটদের আনন্দের উৎসগুলো কবেই বা ধরতে পেরেছে? অগত্যা পুনরায় অনুরোধ করে থামানো গেল বাইক। বাইকের থেকে নেমে আবার কিছুটা হেঁটে গেলাম পিছনের দিকে।
অভিমানভূম
শুভদীপ চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment