শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'শেষ মৃত পাখি' পড়ে লিখেছেন সায়ন কুমার দে। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.................................................................

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের 'শেষ মৃত পাখি' উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশ পেয়েছে সুপ্রকাশ থেকে। এটি শাক্যজিৎ-এর পঞ্চম প্রকাশিত বই, তাঁর প্রথম রহস্য কাহিনী , আর আমার পড়া লেখকের প্রথম বই। প্রচ্ছদ থেকেই প্রকাশ লেখাটি রহস্যকাহিনী। আলো-আঁধারি দার্জিলিঙের আবহে অসামান্য প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন শিল্পী সৌজন্য চক্রবর্তী। চারশো পৃষ্ঠাধিক এই উপন্যাসটি টানটান এক রহস্যকাহিনীকে বিধৃত করে। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে দার্জিলিঙে অকস্মাৎ খুন হন তৎকালীন বাংলা কবিতার জগতের উদীয়মান তরুণ কবি অমিতাভ মিত্র। তাঁর খুনে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হন অভিতাভর একদা ঘনিষ্ঠ বন্ধু অরুণ চৌধুরী, পরবর্তীকালে প্রমাণাভাবে ও আলিবাইয়ের জন্য ছাড়া পেয়ে যান তিনি। কিন্তু সন্দেহ ও অপযশ পিছু ছাড়ে না তাঁর। অরুণ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের জগতে পরিচিত নাম, সাহিত্যানুসারী রহস্য কাহিনী লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি। এর পর অতিক্রান্ত হয়েছে পয়ঁতাল্লিশটি বছর। সম্প্রতিকালে সর্বভারতীয় মিডিয়ার অনুসন্ধানমূলক তদন্তের সাংবাদিক তনয়া ভট্টাচার্য আসেন দার্জিলিঙে। ফিরে দেখতে চান একদা অসমাপ্ত অমিতাভ হত্যাকান্ডকে। এই আখ্যান তাঁর অমীমাংসিত খুন নিয়ে লেখা সিরিজের শেষতম লেখা। তনয়া কী পারবেন রহস্যের যবনিকা উত্তোলন করতে? অরুণ চৌধুরী কী সম্পূর্ণরূপে নিরপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন এই প্রৌঢ় বয়েসে এসে? এই উপন্যাসের পাশাপাশি চলে আরেকটি অসমাপ্ত রহস্যপোন্যাস, অমিতাভর লেখা শেষ উপন্যাস, যা পাওয়া গিয়েছিল তাঁর ডেরায়, হত্যাকাণ্ডের পরে সিজ হওয়া কাগজপত্রের সঙ্গে... কেন অন্য একটি জঁর লেখায় হাত দিয়েছিলেন ব্যতিক্রমী কবি অমিতাভ? এছাড়া এই উপন্যাসে মিশে আছে অমিতাভর চিঠিপত্র, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকারের অংশ, কবিতাভাবনা ও রাজনৈতিক চিন্তা। লেখক খুব যত্নে নির্মাণ করেছেন এই অংশটি, পাঠকের সামনে এই সব চিঠিপত্র বিশ্বাস যোগ্য হয়ে ওঠে তার আবহ নির্মাণের জন্য। কোনো কোনো চিঠি অমিতাভ লিখেছেন সত্তরের ও আশির দশকের তাঁর সতীর্থ কবিকে, উল্লেখ আছে তৎকালীন কবি শামসের আনোয়ার, রণজিত দাশ, মৃদুল দাসগুপ্ত, শম্ভু রক্ষিত, অনন্য রায়, অরণি বসু, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কথা, তাঁদের কবিতা ও কবিতাভাবনার সুস্পষ্ট নির্দেশ। এই আখ্যান তাই নিছক রহস্য কাহিনী নয়, হয়ে ওঠে লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যচর্যার এক জীবন্ত দলিল। চিঠিপত্রগুলিতে উল্লেখ আছে সমকালীন লিটল ম্যাগাজিনের কথা, তার কবি-লেখকদের উপস্থিতি। শাক্যজিতের এই নির্মাণ কুশলী, খুবই অন্যধারার এক আখ্যান। 

রহস্যকাহিনী হিসেবে 'শেষ মৃত পাখি' অনন্য, সাম্প্রতিক কালে পড়া উপন্যাসগুলির মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থানে থাকবে পাঠকের কাছে। প্রাচ্যের রহস্যকাহিনী নির্মাণে মিশেছে পাশ্চাত্যের আবহনির্মাণ। এই উপন্যাসে তাই দার্জিলিঙের বৃষ্টি-কুয়াশাভরা দিন, পাহাড়ি খাদ, পাহাড়ি উপত্যাকার বাঁক,  ব্রিটিশ আমলের গথিক বাংলো, বর্ষাকালে ম্যালের নির্জনতা... এক একটি চরিত্র। রহস্য ঘনীভূত হয়, জটবদ্ধ হয়... হয়তো পরিবেশের কারণেই। কিন্তু সব কিছুর পরেও, লেখক আমাদের সামনে একটি নিটোল রহস্যকাহিনী রাখেন, তনয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকও সেই রহস্যের জট খুলতে খুলতে যায়। এই আখ্যানে রহস্যসন্ধান দ্বিমুখীন, অমিতাভর লেখা অসম্পূর্ণ রহস্য উপন্যাস, অন্যটি অমিতাভর হত্যা রহস্য। একটি রহস্যের মধ্যে মিশে আছে অন্যটি সমাধানের বীজ। চরিত্র নির্মাণেও লেখক মুন্সিয়ানার পরিচয় রেখেছেন। চরিত্রগুলি তাঁর বর্ণনায়, সংলাপে হয়ে ওঠে রক্তমাংসের। প্রতি অধ্যায়ের শুরুতে আছে অমিতাভর সমকালীন কবিতার অংশ, প্রাসঙ্গিক উল্লেখ। 

বাংলা রহস্য সাহিত্যে 'শেষ মৃত পাখি' এক বিশেষ সংযোজন, রহস্য আখ্যান হয়েও যা সাহিত্যধর্ম চ্যুত হয় নি। পাঠক তাই এই উপন্যাস পাঠকালে একই সঙ্গে সাহিত্যপাঠের তৃপ্তি, অন্যদিকে রহস্যভেদের গাণিতিক সমাধান করার আনন্দ যুগপৎ লাভ করে। এখানেই লেখাটি অসাধারণত্বের দাবি রাখে।

▪শেষ মৃত পাখি
▪শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য 
▪মুদ্রিত মূল্য : ৫২০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।