মরুনির্ঝর।। সূর্যনাথ ভট্টাচার্য।।

'মরুনির্ঝরের পরমায়ু বোধহয় এত শীঘ্র শেষ হবার নয়। তাই নির্ঝরিণীর মৃত্যু হয়নি। জলমগ্ন হতেই দুটি পুরুষ হস্ত নির্ঝরিণীর অচেতন দেহ সরযূর তট থেকে তুলে নিয়ে এসেছিল। সংজ্ঞা ফিরে এলে নির্ঝরিণী দেখল তার দেবতাকে। তার মুখপানে চেয়ে তিনি প্রচ্ছন্ন তিরস্কারে বলছেন, মরতে গিয়েছিলি নির্ঝর? আমাকে সর্বস্বান্ত করে?

মরুধর! নির্ঝরিণী বুঝতে পারেনি সুরসাগর নিজেকে উজাড় করে তাকে সব দিয়েছেন। তারই মাঝে আছে এই মানুষটির অলৌকিক সৃষ্টির সুররঞ্জিত উত্তরাধিকার। তার তো এখনই মরা চলবে না। কিন্তু সে সুর— নির্ঝরিণীর একান্ত প্রিয় হৃদয়ের ধন, সে ধনে যে তার আর অধিকার নেই।

উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ে নির্ঝরিণী। অবরুদ্ধ স্বরে বলে, কিন্তু বেঁচে থেকেই বা কী লাভ? আমি যে ধৃতিকে কথা দিয়েছি। মরুনির্ঝর আর আমি গাইতে পারব না। মরুধর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, সে প্রতিজ্ঞা সন্তানকে পিতার থেকে আলাদা করতে পারে না নির্ঝরিণী। মরুনির্ঝর আমার সন্তান। যখন চরাচর ঘুমোবে, আমাকে তুই শোনাবি। শুধু আমাকে।

নির্ঝরিণী বাঁচল। কিন্তু মরুনির্ঝর? সে আর কেউ শুনতে পেল না। গভীর রাতেই সবার অলক্ষ্যে স্রষ্টা ও সৃষ্টিধরী নগর ত্যাগ করে কোথায় চলে গেল। লোকালয় থেকে দূরে, নির্জন নদীতীরে তারা ঘর বাঁধল। জনপ্রাণী জানতে পারল না, সবার অলক্ষ্যে অব্যাহত রইল মরুনির্ঝরের সাধনা। গুরু-শিষ্যার সে নিভৃত আলাপ। এও কেউ জানল না, গুরু ও শিষ্যার ব্যবধান কখন বিলুপ্ত হল।

তারপর পূর্ণিমা এসেছে। মোহময়ী রাত্রি। মরুধর নির্ঝরিণীকে বাহুবন্ধনে নিয়ে বোঝাচ্ছিল মরুনির্ঝরের রূপ। বলছিল, রাগ দেশ প্রিয়বিরহের আকুলতার সুর। কাউকে ভালো না বাসলে তা বোঝা যায় না। এমন কিছু যা তুমি পেয়েও হারিয়েছ, মাঝরাতের একাকী বিলাপে করুণ ভাবে তাই জানাতে চাইছ। সে বিরহে গান্ধার যুক্ত করে অনুতাপ, যেন আপন কর্মদোষে সে প্রিয় বস্তু হারিয়েছ তুমি। আর অনুরঞ্জনীতে আছে হতাশা, যে গেছে আর সে ফিরে আসবে না— সেই হাহাকার। মরুনির্ঝরের যে বিরহ, তার অনুষঙ্গে আছে অন্বেষণ— আমি হারিয়েছি, নিজের দোষেই হারিয়েছি, জানি তা আর কোনোদিন ফিরে পাব না— তবু আমার অন্বেষণ শেষ হয় না।

নির্ঝরিণীর কপাল থেকে একগুচ্ছ কেশ সরিয়ে মরু বলে, কোথায় এর শেষ নির্ঝর? তোর কণ্ঠে এ সুরের অন্ত খুঁজে মরি। আর একবার শোনাবি?

জ্যোৎস্নালোকিত মধ্যযামে নির্ঝরিণী আবার ধরল মরুনির্ঝরের তান। একসময়ে সে রাত্রের মতো যখন শেষ হল তার আলাপ, তখন চন্দ্রবিগলিত ধারায় স্নাত যামিনীকল্প সমাধিস্থ দূর প্রভাতের প্রতীক্ষায়। সহসাই নীরব চরাচরে পিপাসিত চকোর কাতর স্বরে বার কতক চিৎকার করে বলে উঠল, পিউ কাহাঁ— পিউ কাহাঁ—।'

মরুনির্ঝর
সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।