শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।।

গুডরিডস এবং নিজের বুকস্টাগ্রামে সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের রহস্য উপন্যাস 'শেষ মৃত পাখি' পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছেন সালমান জিশান। এখানে রইলো সেই পাঠ প্রতিক্রিয়াটি। 
.................................................

"ওল্ড সিনস হ্যাভ লং শ্যাডোজ। পাপ পুরোনো হলে তার ছায়া দীর্ঘ হয়।"

অমিমাংসিত কেস' বিষয়টা খুবই নিষ্ঠুর। শার্লক হোমস, ফেলুদা, ব্যোমকেশ একটা রহস্যের কিনারা কোনোভাবেই করতে পারছেন না। দিনের পর দিন মীমাংসা না হওয়া কেসটা জমা হচ্ছে কানাইচরণের পুলিশ স্টেশনে, মিসির আলীর অমিমাংসিত ডাইরিতে। বাঘা বাঘা গোয়েন্দারা পারছেন না সমাধান করতে। রহস্যের পোকা হিসেবে, চিন্তার খোড়াক হিসেবে ভেবে দেখলে হয়তো এভাবে ব্যাপারটার সর্বোচ্চ রস আস্বাদন করা যায়। কিন্তু ভুক্তভোগীর পক্ষে ও সাক্ষাৎ মৃত্যুযন্ত্রণা।

যেমন এখানে গল্পটা এরকম যে, চুয়াল্লিশ বছর আগেকার প্রতিশ্রুতিবান তরুণ কবির হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। শিল্পকর্মের চাইতে সুন্দর দার্জিলিং এ তারচেয়ে বড় শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে হাওয়া হয়ে গেছে খুনী। সকল দিকে আঙুল উঠেছে, মৃতের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, লেখক অরুণ চৌধুরীকে বছর কে বছর সন্দেহ করেছে সবাই। একসময় ভুলেও গেছে। কিন্তু এই দীর্ঘকালীন ক্ষত, একটা পরিবারের সাফারিং কোনদিন শেষ হয়নি। আবার সেই গল্পটাই শোনাতে এলেন সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক তনয়া ভট্টাচার্য।

এ বই একটা মন ভারী করা মেলানকোলিক ভ্রমণকাহিনীর মতো সুন্দর। দার্জিলিং এর পাহাড়ি জীবন, পোড়া ব্রিটিশ বাংলো, গথিক ছাদের মিনার, লোহার রেলিং, আর্দ্র পাইনের চামড়া, পাহাড়ের গায়ে শ্যাওলা ধরা সিঁড়ি, ম্যাল রোডে টুপটাপ জোনাকির মতো ফুটে ওঠা পথচারীর দল, ঘন বর্ষা প্রকৃতি, ওখানকার সামাজিক অবস্থা কিংবা পাহাড়ি বৃষ্টি...যে বর্ণণাটাই দিয়েছেন লেখক, খুব মেপে সুন্দর করে। ওতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যটা পড়তে গিয়ে উপভোগ করা গেছে শতভাগ।

তবে এখানে সবচেয়ে প্রমিনেন্ট বিষয় ছিল কবিতা। রগড়ে রগড়ে হাড়, কন্ঠা, শিরা, নাভিমূল সেঁচে, মন মেজাজ বিদীর্ণ করে শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে কবিতার আলাপ। থাকেনা কিছু বইতে মূল বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে বেরিয়ে আসে ইতিহাস, সভ্যতা বা বিজ্ঞানের কপচানি? এতে ছিল কবিতা। আরও ছিল কবি, মূলধারার সাহিত্য, রহস্য সাহিত্য, লিটল ম্যাগ নিয়ে নানান আলাপচারিতা। ব্যোমকেশ থেকে ফেলুদার দেশীয় গোয়েন্দাকাহিনীর যুক্তি কাঁটাছেঁড়া হোক, গোল্ডেন এজ ডিটেক্টিভ হোমস, এরকুল পোয়েরো থেকে জাপানি হনকাকু ঘরানার লকডরুম মিস্ট্রির জন্ম নিয়ে সমালোচনাই হোক। নিজের সাথে নিজেকে আলাপ করালাম মনে হলো সাহিত্যের গলিঘুপচিতে নিয়ে।
ইতিহাস ছিল। ষাট সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ...একটা উত্থান পর্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যেটাকে বলে আরকি। ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, শক্তি, রণজিৎ দাশ, শম্ভু, কাঞ্জিলাল প্রমুখ কবি, কবির কবিতার বাস্তবিক প্রেক্ষাপট কিংবা সমালোচনা। কবিতা তো অত পড়িনাই, মাঝে মধ্যে কবিতা, সে সময়কার চিঠি চালাচালি, সাহিত্যসুধা নিয়ে বৈঠক পড়ে নিজেকে গন্ডমূর্খ লাগছিলো, হতাশ লাগছিলো। এরপরেও সাবধানে ধীরে ধীরে পড়ে গিয়েছি যাতে কোনো রহস্যের সূত্র না ছুটে যায়। এতে একটা লাভ হয়েছে। কবিতা যে শুধু কটা লাইন নয়, একে যে অনুভবেরও একটা বিষয় আছে, এরও যে জ্বালিয়ে দেবার শক্তি আছে ওতে বোধহয় প্রথমবারের মতো সতর্ক হলাম।

তারপরও পিঁয়াজের খোসার মতো স্তরে স্তরে উদ্ধার করতে হয়েছে গল্প....উপন্যাসের ভেতর উপন্যাস, পাতার পর পাতা ছুটোছুটি, চরিত্রের ছড়াছড়ি আর আর্টিকেল লেখবার সত্যিকার গবেষণার স্বাদ, সবই পেয়েছি। একবার একে সন্দেহ করেছি, একবার ওকে সন্দেহ করেছি। সব গুলো গল্প, সবগুলো পার্স্পেক্টিভও মেইক সেন্স করছিল। ক্লান্ত লাগার কথা, ক্লান্ত লাগেনি গল্প বলার ঢং-এর জন্য। চরিত্রেরা ধীরে ধীরে পার্ফেক্ট পরিণতি পেয়েছে। একেক জবানিতে পরিষ্কার হয়েছে একটু একটু কি হয়েছিল এই হত্যাকান্ডে। মায়া হচ্ছিলো কোনো কল্পিত ব্যক্তির জন্য। শুধু ওই একটি মূহূর্তে তিনি উপস্থিত না-ই থাকতে পারতেন সেখানে। নাকি এটাই প্রকৃতির খেয়াল-

Yesterday upon the stair
I met a man who wasn't there
He wasn't there again today
I wish I wish he'd go away

একটা বিষয় লক্ষণীয়। আমি বাংলা রহস্য সাহিত্যে খুব একটা নারী প্রোটাগনিস্ট এর দেখা পাইনি। অবাক হলেও সত্য, যে ক'টি পেয়েছি প্রায় সবকটিই কোলকাতার লেখকদের কল্যাণে। তনয়া ভট্টাচার্যকে আমার মনে ধরেছে। স্মার্ট মহিলা। তিনি একেবারেই গোয়েন্দাগিরি করতে চাননি যেটা উনি প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত দাবী করে গেছেন। তিনি শুধু একটা রিপোর্ট করতে চেয়েছেন, একটা গল্প বলতে চেয়েছেন। গোয়েন্দারা সরাসরি জিজ্ঞেস করেনা, ও ভাই আপনিই কি খুন করেছেন? কিভাবে করেছেন? কেন করেছেন? বলে দেন, চলে যাই। সাংবাদিকরা করেন। তনয়াও করেছেন, কিন্তু কেউ বলেনাই। একরোখা সাংবাদিক তো, গল্প উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন।

রহস্য চাই, তবুও মনের ভেতরে কোথায় যেন রহস্যের ইতিও চাই। লেখক শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য ইতি টেনেছেন। পোয়েটিক জাস্টিস না পাই, পোয়েটিক কনক্লুশান পেলাম। যেমনটা সন্দেহ করলাম তেমনটাই হলো, তৃপ্তি নিয়ে বই বন্ধ করবো, লেখক বললেন, সব ভুল, সব! মাথাটা ঘুরে গেলো। খুঁটিনাটি যা যা সূত্র মনের ভুলে এড়িয়ে গেছি, সেসব জোড়া দিয়ে ওই একই সমাপ্তিটার আরেকটা বিকল্প তিনি হাতে ধরিয়ে দিলেন।

বইটি আমার পক্ষ থেকে রেকোমেন্ডেড। বাংলা সাহিত্যে এরকম গর্দান ভেঙে দেয়া লেখা আসুক।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।