বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া।। সম্পাদনা : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।।

'মসজিদ রোডের মসজিদটা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই বাতাসা-নকুলদানার দোকানগুলোর গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট দোকানটাতে বাকরখানি মিলতো। রুটির বাকরখানি তৈরি হতো ময়দা, সোডা আর ডালডা মিলে। সকালের টিফিনের জন্য অনেকেই প্রচুর বাকরখানি কিনে নিয়ে যেতেন বাড়িতে। এগুলো সহজে নষ্ট হয় না বলে। শহুরে হিন্দুরা বাকরখানিকে 'মুসলমানি খাবার' বলে এড়িয়ে চলতেন।

শহর করিমগঞ্জের কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে এক নদী। নাম কুশিয়ারা। ঘাটের খুব কাছেই স্বস্তি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দু'চারটে ছেলে বসে রয়েছে। ততদিনে এদের কেউ কেউ চাকরিতে ঢুকে পড়েছে, বাকিরা কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ পলিটেকনিক পড়ছে। টেবিলে ছড়ানো দু-একটা ম্যাগাজিন, কিছু কাগজ, কলম, সিগারেটের প্যাকেট আর একটা টুপি। 'স্বস্তি'র গরম গরম কচুরি খেতে খেতেই ওরা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়, কবিতা লেখে, হেঁড়ে গলায় আবৃত্তি করে ‘মারী ফারারের ভ্রূণ হত্যা'। ছেলেগুলো দোকানে বসে যে রাতে এসব হ্যানোতেনো করে, তার পরদিন ভোরবেলা বেরিয়ে শহরবাসীর চোখে পড়বে পার্কের রবীন্দ্রমূর্তিটার মাথায় কে যেন সুদৃশ্য একটা টুপি চাপিয়ে গেছে।

হাসপাতালের আশেপাশে এখনকার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো অনেকগুলো খাবারের দোকান। হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসা শহরের বাইরের রুগীদের সাথে থাকা আত্মীয়স্বজনেরা এগুলোতেই পেটপুজোটা সেরে নিতেন। চা-বিস্কুট, রুটি-ঘুগনি, ভাত-ডাল সবকিছুরই বন্দোবস্ত ছিল এগুলোতে। বাঁশের ছাউনি দেওয়া ঘর। ঝড়-বৃষ্টির দিনে মুশকিল হয়ে যেত। আবার কখনো হাসপাতাল সংলগ্ন অঞ্চল পরিষ্কার রাখতে গিয়ে দোকানগুলোকে ভেঙে ফেলা হতো। রুগীর স্বজনরা তখন পড়তেন বেজায় সমস্যায়। সস্তায় পেট ভরে খাওয়ার অন্য কোনো ঠিকানা জানা নেই। আর দোকানিদেরকেও তখন বাধ্য হয়ে পেশা পাল্টাতে হতো।

হাসপাতাল আর পাবলিক স্কুলের মাঝামাঝি থাকা পাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়তো দেয়ালে ঝোলানো দোকানের স্বত্বাধিকারীর কোট-পরা মেগা সাইজের ছবিটার দিকে। প্রথমবার যারা এ দোকানে পা রাখতেন একটু চমকে যেতেন। ছবিতে যিনি, তিনিই তো দিব্যি কাউন্টারে বসে আছেন। হ্যাঁ, ভুল নেই কিছু। ছবিতে নিজেতে দেখতে ঠিক কেমন লাগে তা দেখার নিরন্তর তাড়না থেকেই পালমশাই জীবদ্দশাতেই হয়তো এই অদ্ভুত কাজটা করেছিলেন। ছোটোবেলায় কিছুদিন কলকাতায় কাটিয়েছেন। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা এখনও কলকাতায় ভোরবেলা রাস্তাঘাট ধুইয়ে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। মুড ভালো থাকলে হগ সাহেবের মার্কেটের অনেক গল্প শোনা যেত। প্রথম দিকটায় এ দোকানের ফুলকপির সিঙাড়ার সাথে পরিবেশন করা স্বাদু চাটনিটাতে খেজুর আর আপেলের টুকরো পাওয়া যেত।

নদীর ঘাট থেকে পার্কের দিকে বরাবর হাঁটতে থাকলে একটু এগিয়েই মেয়েদের কলেজ। কলেজের ঠিক উল্টোদিকেই ছিলো একটা ছোট্ট বাক্সদোকান। দোকানের মালিক কলেজের মেয়েদের দাদু। আবার ওদের বাবাদেরও দাদু ইনি। কখনো-সখনো বাবা-কাকারাও এসে পড়েন দাদুর দোকানে। দাদুর কাছে সারা বছর ধরেই তেতুলের আচার মেলত। আমের, কুলের—আরো কতকিছুর আচারও। সবই দাদুর নিজের হাতে বানানো। দাদুর ব্যবসাটা ছিল একচেটিয়া। শহরের কোত্থাও আর এগুলো পাওয়া যেত না।

মফস্বলে শীত আসে। স্কুল-কলেজ থেকে ফেরার পথে ছেলেরা-মেয়েরা দেখতো গঙ্গা ভাণ্ডারের উল্টোদিকের খোলা জায়গাটায় চোঙা পিঠের বাঁশ আর বিরুন চাল নিয়ে বসেছে। বোঝা যেত পৌষ-সংক্রান্তি এসে পড়লো তবে। সংক্রান্তির পর পরই পাবলিক স্কুলের খেলার মাঠ জুড়ে বসতো নেতাজী মেলা। দিন পনেরোর এই মেলা। সেবারে মফস্বলীয় গালগল্পে শোনা গেল মেলাতে চাট হাউস এসেছে প্রথমবার। দিল্লি চাট হাউস। দোকানের লোকেরা হিন্দিতে কথা বলে। বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে একথা শুনে ছেলেরা বায়না ধরে একদিন অন্তত চাট হাউজে খেতেই হবে। একসময় বাবা-মা'কে মেনে নিতে হয় আব্দারটুকু। ছেলের দল গিয়ে বসে। এধরণের দোকানে বসার অভিজ্ঞতা নেই বড়ো-ছোটো কারো। কী কী পাওয়া যায় তারও ধারণা নেই। তাই খাবারের নাম না বলে ওরা শুধু '৫ প্লেট' বলে বসে থাকে। দোকানের লোকেরা অবাক হলেন কি? যাক, খাবার আসে। সেগুলোর স্বাদ কেমন ছিল তা না বলে এটুকু জানিয়ে রাখা যেতে পারে যে, এরপর থেকে কোনো বারের মেলাতেই ওরা আর কোনো চাট-হাউসমুখো হয়নি।

এভাবেই দিন যায়। বয়ে চলে কুশিয়ারা। ছলাৎছল। করিমগঞ্জের আকাশে যুদ্ধ-বিমান প্রত্যক্ষ করা একাত্তরের সেই সব যুবক-যুবতীদের পরবর্তী প্রজন্মও বড়ো হয়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে পাড়ি জমায়। এদিকে সীতারামদা আবার ফিরে আসে। সবগুলো চুল সাদা হয়ে গেছে। আগের জায়গাটাতে নয়, শহরের অন্য কোনো প্রান্তে টিমটিম করে টিকে থাকে ওর দোকানটা। আর, সিনেমাহলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দোকান-গাড়ির ঘুগনিওয়ালা আজ এক মিষ্টির দোকানের বুড়ো কর্মচারী। এদিকে চীনের চাউমিন আমাদের চাউমিন হয়ে রাস্তার পাশের দোকানেও ঠাঁই পেয়ে যায়। যেখানে পোলাও-বিরিয়ানি-চাউমিনেরা ঢাকা থাকে লালশালুর তলায়। যেখানে টিউশন-ফেরৎ মেয়েরাও দিব্যি এসে প্লেট হাতে এখন দাঁড়িয়ে পড়ে। তবু অনেকেরই দিন পাল্টায় না। আর, তবু লড়াই থেমে থাকে না। চাল-ডাল-তেল-ডিম জোগাড় করার লড়াই। একটু ভালোভাবে বেঁচেবর্তে থাকার লড়াই থেমে থাকে না। চলতেই থাকে। ঠিক আগের মতোই। তাদের যাপিত জীবন আর লড়াইয়ের আলোকবর্ষ দূরে বিরামহীন স্বাচ্ছন্দ্যের বলয়ে বেষ্টিত একলা ঘরের ভেতর থেকে কোনো কোনো রাত্তিরে যে তুমুল হাততালি ভেসে আসে কেউ বুঝতে পারে না সেগুলো আসলে সীতারামদার জন্য, আচারের দোকানের দাদুর জন্য, বাদামওলা-সরিভাজাওলা- ঘুগনিওয়ালাদের জন্য, রাস্তার পাশের মিষ্টির দোকান আর ঘুপচি দোকানগুলোর ভেতরে দিন-রাত গুজরান করা শিশু-শ্রমিকদের জন্য। করতালির মাঝেই রাত গভীর হয়ে আসে। আলো ফোটার আর দেরি নেই। সুরক্ষা বলয়ের ভেতরের লোকেরা তা জানে। বাইরের লোকেরাও।

করিমগঞ্জের হারানো মুখ, হারানো মুখরোচকেরা
শাশ্বত পুরকায়স্থ
.................................................
বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া
সম্পাদনা : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদ : শোভন সরকার
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত, শোভন সরকার, মেখলা ভট্টাচার্য 
মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা

#সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।