হিমশীতল রহস্য।। সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়।।

'আমাদের এখানকার ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপের মেয়াদ কালই শেষ হতে চলেছে। ভাবতে ভাবতেই দেখি জন বিমর্ষ হয়ে গাড়িতে উঠল। কদিন ধরেই ওর মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে। থিংভেলিরে আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব। জায়গাটার ভৌগোলিক গুরুত্ব অনেকখানি। ইউরেশিয়ান প্লেট আর উত্তর আমেরিকান প্লেটের চলাচলের কারণে কোথাওবা ফাটলের মতো হয়ে যায়। সেই ফাটলের জমা জলে স্কুবা ডাইভিং করে অনেকে। এরকম এক ফাটলের নাম সিলফ্রা। তার পঞ্চাশ ফুট গভীরতায় স্কুবা ড্রাইভাররা ডুব দিয়ে থাকেন। প্লেটের নড়াচড়ার জন্য উপত্যকার দক্ষিণে জল জমে আইসল্যান্ডের সবচেয়ে বড় সরোবরটির উদ্ভব হয়েছে। যার নাম 'থিংভালভান'। সরোবরটি বিশাল আর মুগ্ধ হবার মতোই সুন্দর।

থিংভেলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চলেছি এবার। সুদূর অতীতে আইসল্যান্ডের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে গোষ্ঠীপতিরা যখন আইনের অনুশাসনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন তখন উপযুক্ত স্থান খুঁজতে খুঁজতে তারা থিংভেলিরে পৌঁছে যান। এক বিশাল সমতলের ওপরের টিলায় বসে সেই আসর, যেখানে সাধারণ আইনের অনুশাসন ঘোষণা করেন আইনাধক্ষ্য। নীচের বিশাল চাতালে বসে জনগণ শোনেন সেই আলোচনা। দ্রষ্টব্য জায়গায় পৌঁছে আমি দেখলাম ক্যারোলিনা আর সুভাষকাকুর ঠিক পেছন পেছন চলেছে এরিক। আমি দ্রুত পৌঁছে গেলাম ওদের কাছে। এরিক আস্তে আস্তে গেল এগিয়ে। এই এরিককে কেন জানি না আমার খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। সবসময় আমার, ক্যারোলিনা কিংবা সুভাষকাকুর কাছাকাছি ঘুরঘুর করে চলেছে। ওকি স্পাইয়ের কাজ করছে? কে জানে? আর আমাকে দেখলেই সবগুলো দাঁত বার করে হাসি ঝলমল মুখে একটা 'হাই” বলে। তখন ওকে কেন জানি না খুব চেনা চেনা লাগে। কোথায় যে দেখেছি ওকে? কোথায়? কিছুতেই মনে করতে পারি না।

শেষ পর্যন্ত আমরা কালো কুচো পাথর বিছানো রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম। এই রাস্তাটাকেই 'থিংভেলির ওয়াক ওয়ে' বলা হয়। রাস্তাটা ভারি অদ্ভুত। দুপাশে খাড়া আগ্নেয় পাথরের পাঁচিলের মধ্য দিয়ে সোজা এগিয়ে চলেছে। ডানদিকের পাঁচিলটি যুক্ত উত্তর আমেরিকান প্লেটের সঙ্গে, বাঁদিকেরটি ইউরেশিয়ান প্লেটের সঙ্গে। বাঁদিকে বয়ে গিয়েছে ছোটো এক জলপ্রপাত থেকে বেরোনো নদী। দুটি প্লেট একটু এদিকওদিক হলেই রাস্তা ঢুকে যাবে মাটির নীচে আর আমরা সবাই অবধারিতভাবেই ঢুকে যাব পাতালে। তবে তার থেকেও বেশি ভয়ংকর এক দৃশ্য অপেক্ষায় ছিল আমাদের। সেটিও একটি জলাশয়, যার তীরে লাগানো একটি বোর্ডে জানানো হয়েছে ওই জলাশয়ে ১৬১৮ থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে আঠারোটি মেয়েকে ডুবিয়ে মারা হয়েছে সামাজিক অনুশাসনের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য। ভয়ংকর ওই জলাশয়ের ছবি তোলার প্রবৃত্তি আমার হল না।

হোটেলে ফিরে আসার পরেও মাথা থেকে ওই বিরাট জলাশয় আর তার বিষাদকাহিনি মুছে যায়নি। নিজের বিছানায় গড়িয়ে গিয়ে সেসবই ভাবছিলাম। কাকু কখন হোটেলের ঘর থেকে বেরিয়েছেন খেয়াল করিনি। খেয়াল হল যখন হন্তদন্ত হয়ে এসে আমাকেই বললেন, “ক্যারোলিনাকে দেখেছিস?

আমি সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকেটটা গলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আর দুজনে দ্রুত নেমে এলাম দোতলা থেকে। পথে যেতে যেতেই নজরে এলো ক্যারোলিনার ঘরের দরজা লক্ করা। তার মানে ক্যারোলিনা ঘরে নেই। নীচে নেমে হোটেলের লবিতে পৌঁছতেই দেখলাম কয়েকজন পুলিশ এসেছে। বাইরের গাড়িতে আরো বেশ কয়েকজন বসে।'

হিমশীতল রহস্য
সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ : সুমন্ত গুহ
মুদ্রিত মূল্য : ২২০ টাকা

#সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।