দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত সেকালের চিত্র চরিত্র।। সম্পাদনা : শতঞ্জীব রাহা।।

'ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি এক কৃষ্ণাচতুর্দশী, রাত্রে বাহিরে যেমন দুর্ভেদ্য অন্ধকার, ঘরে তেমনই দুঃসহ গুমট; রাত্রি দশটার সময় আমার পাঠ-গৃহে টেবিলের ওপর দুই পা তুলিয়া দিয়া চেয়ারের ওপর অর্ধশায়িতভাবে বসিয়া কেরোসিনের উজ্জ্বল আলোকে একখানি ইংরেজি নভেল পড়িতেছিলাম। নভেলের নায়ক জাপানি, নায়িকা ইংরেজ দুহিতা; রস বেশ জমিয়া আসিয়াছিল। আমাদের গৃহপ্রান্তবর্তী রাজপথ জনশূন্য, কোনো দিকে জনমানবের সাড়াশব্দ ছিল না ; কেবল অদূরে বাঁশ-বনের অন্তরালবর্তী একটি জলপূর্ণ গর্তে নানাজাতীয় ভেক সমস্বরে বর্ষার আহ্বান-সংগীত গাহিতেছিল; তাহাদের সেই অশ্রান্ত মকধ্বনি বর্ষাসলিলে সিক্ত পল্লী-প্রকৃতির রহস্যভাষের ন্যায় কর্ণে প্রবেশ করিতেছিল। গৃহপ্রান্তে নিবিড় দূর্বাদলের অন্তরালে ঝিঁ ঝিঁর দল যেন করাত দিয়া কাঠ চিরিতেছিল; সে শব্দের বিরাম নাই, বিশ্রাম নাই। গৃহপ্রাঙ্গণস্থিত কাঁঠাল গাছ ও শিশু গাছের পাতায় পাতায় সহস্ৰ সহস্ৰ জোনাকি টিপ টিপ করিয়া জ্বলিয়া প্রকৃতির অন্ধকার যবনিকার ওপর হীরকচ্ছটার বিকাশ করিতেছিল এবং দুই একটা শৃগালকে মধ্যে মধ্যে আম বাগানের ভিতর দিয়া যাইতে দেখিয়া আমাদের ‘বাঘা' কুকুরটা রোয়াকের ওপর বসিয়া এক এক বার চিৎকার করিয়া উঠিতেছিল। এমন সময় সু—বাবুর ভৃত্য খুদিরাম হালদার আমার গৃহদ্বারে উপস্থিত হইয়া বলিল—'রাত্রি তিনটার সময় বাবু 'জল বেড়াইতে' যাইবেন, আপনাকে সংবাদ দিতে বলিলেন।’—বাবুর অদ্ভুত শখের পরিচয়ে কিছু ভীত হইলাম, কিন্তু দমিলাম না। রাত্রি তিনটার পূর্বেই উঠিতে হইবে ভাবিয়া সেদিন একটু সকালেই নিদ্রাদেবীর আরাধনায় প্রবৃত্ত হইলাম।

নির্দিষ্ট সময়ে উঠিতে পারিব কি না ভাবিয়া মন বড়ো উৎকণ্ঠিত হইল; শীঘ্র নিদ্রাকর্ষণ হইল না; বড়ো গরম বোধ হইল; শয়ন-কক্ষের দুই একটি বাতায়ন খুলিয়া দিলাম; দেখিলাম, কৃষ্ণবর্ণের মেঘে পূর্বাকাশের নক্ষত্রগুলি ঢাকিয়া গিয়াছে । তাহার পর কখন যে ঘুমাইয়া পড়িলাম, বুঝিতে পারি নাই। হঠাৎ শীতল জলকণাস্পর্শে নিদ্রা ভাঙিয়া গেল। প্রভাত হইয়াছে ভাবিয়া শয্যায় উঠিয়া বসিলাম । মুক্ত বাতায়নপথে চাহিয়া দেখি, মুষলধারে বৃষ্টিপাত হইতেছে। ছাদের জল 'নালি' দিয়া সশব্দে নিচে আছড়াইয়া পড়িতেছে; সমস্ত আকাশ গাঢ়কৃষ্ণ মেঘে সমাচ্ছন্ন, যেন প্রলয়ের বর্ষণ আরম্ভ হইয়াছে!—ঘড়ি খুলিয়া হারিকেন ল্যাম্পের আলোকে দেখিলাম, রাত্রি আড়াইটা, আর অর্ধঘন্টা দূরের কথা, সমস্ত রাত্রির মধ্যে যে বৃষ্টি ছাড়িবে তাহারও সম্ভাবনা নাই বাতায়নগুলি রুদ্ধ করিয়া পুনর্বার শয়ন করিলাম, আর কোনো উদ্বেগ রহিল না।

প্রভাতে নিদ্রভঙ্গে দেখিলাম, বৃষ্টি থামিয়া গিযাছে, আকাশ অনেকটা পরিষ্কার, অরুণের লোহিত কিরণ নির্গলিতাম্বুগর্ভ শুভ্র মেঘস্তরে পড়িয়া বড়ো মনোহর কান্তি ফুটাইয়া তুলিয়াছে, কে যেন মেঘে সিন্দুর ঢালিয়া দিয়াছে! প্রভাত-অরুণের রক্তিমচ্ছটা শার্সির ওপর পড়িয়া চিক্ চিক্ করিতেছে।

ভাবিলাম, বন্ধুবর বোধহয় দলবল লইয়া প্রত্যূষেই জলযাত্রা করিয়াছেন।

হঠাৎ বাহিরে ডাক শুনিলাম—‘বাবু, বাবু!’

পূর্বরাত্রের খুদিরাম হালদার জানাইল, বাবুরা নৌকায় উঠিতেছেন, আর বিলম্ব নাই।

পাথারে ভাসিবার জন্য ভরা অমাবস্যায় গৃহত্যাগ করিলাম। খোকা আবদার ধরিল— আমি যাবো, বাবা! তাহাকে ধমক দিয়া বন্ধুগৃহে উপস্থিত হইয়া দেখি— বন্ধুবর পরমনিশ্চিন্তচিত্তে গড়গড়ার নল মুখে পুরিয়া মক্কেলের আর্জি দেখিতেছেন!

আমি বলিলাম—'রবিবারেও মামলা! স্বর্গে ঢেঁকিকে বিশ্রাম দাও, ওঠো, বেলা হইয়া গেল।'

বন্ধু বলিলেন—'বসো, সংকীর্তন পার্টির সকলে আসিয়া জুটুক। পাথারে সংকীর্তন বড়ো মধুর লাগিবে।'


পাথারে

দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত
সেকালের চিত্র চরিত্র

সংকলন, সম্পাদনা, টীকাঃ শতঞ্জীব রাহা

মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৯০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।