শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'শেষ মৃত পাখি' পড়ে লিখেছেন আজরফ ইসলাম অর্ক। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.................................................................

রহস্য কাহিনী কবিতার সৌন্দর্যকে ছুঁয়ে থাকে। রহস্যের যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে দ্বিধা,অনিশ্চয়তা আর বিশৃঙ্খলার মাঝে, তার থেকেই পুষ্টি নিয়ে ডালপালা মেলে কবিতা। কঠিন কবিতার মানে খুঁজে বের করবার আনন্দ তো খুনের অপরাধীকে শনাক্ত করবার থেকে কম নয়।
তাই বুঝি,‘মানুষ বড় শস্তা , কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো’ শুনলে গা-টা শিরশির করে উঠে। 

মেঘ পাহাড়ের দেশ দার্জিলিং। বৃষ্টি অবিরত। গাঢ় সবুজে জলকণা,পাতার সিক্ত মুখ। ময়াল সাপের একসা শরীরের মতোই ভিজে যাচ্ছে ম্যাল,জলাপাহাড়,লেপচাজগৎ,কার্ট রোডের কবরখানা আর ঋষি রোডের সেই বাড়িটা। বৃষ্টি আর কুয়াশার ধোঁয়াশায়,হিমেল হাওয়ায় অতীত খুঁড়ে এক দুঃসহ স্মৃতিকে জাগাতেই যেন সেখানে হাজির হলেন সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক তনয়া ভট্টাচার্য। অমীমাংসিত খুনের কাহিনী নিয়ে তিনি ধারাবাহিক লিখছেন পত্রিকায়। দার্জিলিংয়ে আসার উদ্দেশ্য— সেই ধারাবাহিকের শেষ কাহিনীটার শেকড় সন্ধান। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দার্জিলিংয়ের এক সম্ভাবনাময় কবি,অমিতাভ মিত্র খুন হয়েছিলেন। আর সেই খুনের দায়ের আঙুল উঠেছিলো তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরবর্তীতে বিখ্যাত রহস্য-ঔপন্যাসিক অরুণ চৌধুরীর দিকে। কিন্তু রহস্যটা অমীমাংসিত থেকে যায়,পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারে নি সেটা। এতো বছরের ব্যবধানে কি সেই পুরোন পাপের দীর্ঘ ছায়ার উপর আলো ফেলে আসল অপরাধীকে চিনে নিতে পারবেন তনয়া? নাকি এসব ঘটনার ঘনঘটাই কারো নির্মিত মিথ্যের আবরণ? 

চার অন্ধের কিসসাটা জানেন? সেই কিসসায় চারজন অন্ধকে দাঁড় করানো হয়েছিলো, একটা হাতির সামনে। তাদের কেউ ধরলো হাতিটার দাঁত,আর কেউ ধরলো তার লেজ। একজন এসে ধরলো হাতিটার কান,আরেকজন ধরলো তার পেট। পরে যখন জিজ্ঞেস করা হলো আসলে তাদেরকে কী জিনিস দেয়া হয়েছে,একেকজনের উত্তর আসলো একেকরকম। কেউ বললো, "এটা একটা দেয়াল।" কেউ বললো,"সাপ।" কারো কাছে মনে হলো, বর্শা বা রঙতুলি। আবার কারো কাছে জাহাজের পাল বা হাতপাখা। কিন্তু আমরা আসলে জানি সেখানে দাঁড়িয়েছিল একটা হাতি। এখানে আসলে কেউই কিন্তু মিথ্যা বলে নি।। হাত দিয়ে স্পর্শ করবার পর তাদের কাছে যা যা কল্পনীয় আর অনুমেয় মনে হয়েছে তারা ঠিক ঠিক সেই উত্তরটাই কিন্তু দেয়। কিন্তু আসলে কী ঘটেছে আর তারা কী সাক্ষ্য দিচ্ছে তার মাঝে কিন্তু আকাশপাতাল তফাৎ। পরস্পরবিরোধী অথচ সমানভাবে যুক্তিসঙ্গত বক্তব্যের কারণে জট পাকিয়ে ঘোলাটে হওয়া এই রহস্যকেই বলা যেতে পারে "রশোমন ইফেক্ট"। এখানে কিন্তু প্রত্যেকের বক্তব্য সমানভাবে "সত্য" হবার ব্যাপারে কিছু বলা হয় নি। এই বক্তব্য মিথ্যা,অনির্ভরযোগ্য বা ধোঁয়াশাপূর্ণ হতে পারে। আর এখানেই এসে পড়ে আনরিলায়েবল ন্যারেটর বা অনির্ভরযোগ্য কথকের বিষয়টা। একটা গল্প যখন বলা হয় তখন যার জবানিতে গল্পটা বলা হচ্ছে আপনি তার কথার উপর কতটুকু নির্ভর করতে পারেন সেটা হয়ে দাঁড়ায় বড়সড় একটা প্রশ্ন। আর লেখক সে সুযোগে আপনাকে শুরু থেকেই এমন কিছু সূত্র দিতে থাকে যার কারণে আপনি আগেভাগেই রহস্যের কিনারা করতে চান,আর শেষটায় গিয়ে আপনার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় "অতিশয় পুষ্ট মর্ত্যমান রম্ভা " বা এক কাঁদি পাকা কলা  ঠিক এমনটাই করতে দেখা যায় বর্তমানের বেশিরভাগ জনপ্রিয় থ্রিলারগুলোতে। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের ‘শেষ মৃত পাখি’ পড়তে গিয়ে আলিফ লায়লার গল্পের ভেতর গল্পের প্যাটার্নে পাঠক মুখোমুখি হবেন এমন সব সত্যের,যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে আসলেই ঘটেছিলো। 

এর আগে অ্যান্টনি হরোউইটযের ‘ম্যাগপাই মার্ডারস’, রাইলি স্যাগারের ‘হোম বিফোর ডার্ক’ বইগুলোতে এই ধরনটার সাথে পরিচিত হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু এতো কাকতালীয় ঘটনার সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিলে তার সার্থকতা কোথায়? এই আখ্যান তাই আপনার আমার কল্পনার অতীতে দাঁড়িয়ে এক বাস্তবের অভিক্ষেপ,যেখানে কে যে সত্য বলছে, আর কে মিথ্যা-সেইটেই ধরাটা মুশকিল। পিঁয়াজের খোসার মতো স্তরে স্তরে লুকিয়ে আছে সেই খুনের  সম্ভাব্য নেপথ্য কাহিনীর বিকল্প....

‘শেষ মৃত পাখি’-কে শুধু পিচ পার্ফেক্ট ক্রাইম কাহিনী বলাটা বোধহয় বড়সড় অপরাধ হবে। কারণ,এর বাইরেও এমন কিছু দিক এর সাথে জড়িয়ে আছে যেটা উপন্যাসটিকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মান। এই বিস্তৃত আখ্যানের পেছনের শক্তিশালী প্রেক্ষাপট রহস্য কাহিনী হিসেবে একে সীমাবদ্ধ থাকতে দেয় নি। বইটা প্রতিনিধিত্ব করছে সত্তরের দশকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুধ্ব অস্থির সময়ের। শুধু নকশাল আন্দোলন,বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধই না, সেসময়টায় বাংলা কবিতার জগতে যে শক্তিশালী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলটা ঘটেছিলো তার এক জলজ্যান্ত চিত্রকে ধরে রেখেছে ‘শেষ মৃত পাখি’... একটা খুনের রহস্য সমাধান করতে গিয়ে কাহিনীতে ঢুকে পড়েছে প্রসূন বন্দোপাধ্যায়,রণজিৎ দাশ,কৃষ্ণা বসু,পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল,অনুরাধা মহাপাত্র,শম্ভু রক্ষিতসহ সেসময়ের কবিদের কবিতা,কবিতার বিষয়বস্তুর কেন্দ্রীয় প্রবণতা,সাহিত্যচর্চায় লিটল ম্যাগাজিনগুলোর প্রভাব। মাঝে মাঝে পড়তে গিয়ে মনে হয়,বইটার উপরে লেখা রহস্য কাহিনী শব্দবন্ধ কি বইটার ভারকে কমিয়ে দিচ্ছে? লেখক আসলে রহস্য কাহিনীর আদলে যেটা করতে চেয়েছেন সেটা হলো সিরিয়াস সাহিত্য। দুইটা টাইমলাইনে চলতে থাকা গল্পকে সফলভাবে এক বিন্দুতে গিয়ে মেলানোর জন্য এলেম থাকাটা জরুরি। সত্তরের দশকের দার্জিলিংয়ে হয়ে যাওয়া একটা খুনের রহস্যকে সমাধান করতে চেয়েছেন বর্তমানের প্রেক্ষাপটে। স্বভাবতই এই কাহিনীর মূল কঙ্কালকে অক্ষত রাখতে দুই সময়ের শাসনব্যবস্থার সামঞ্জস্য, অস্ত্রের ব্যবহার, সমসাময়িক নানা ঘটনাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ আর সেটাকে কালো অক্ষরে বেঁধে ফেলতে এক পাহাড়সম প্রস্তুতি নিতে হয়েছে লেখককে। 

‘শেষ মৃত পাখি’ বইটার ক্যারেকটার বিল্ডআপ দেখার মতো। কাহিনীর মূল রক্তকণিকারা অরুণ চৌধুরী, অমিতাভ মিত্র,ড্যানিয়েল লামা থেকে শুরু করে তনয়া ভট্টাচার্য, সিদ্ধার্থ তো বটেই, এই বইয়ের আড়ালে যে আরেকটা রহস্য কাহিনী লুকানো আছে অমিতাভের অসমাপ্ত  উপন্যাস হিসেবে, তার কল্পিত চরিত্রগুলোকেও খুব যত্ন করে, বিস্তৃত করে নির্মাণ করেছেন শাক্যজিৎ।  চরিত্রগুলোর বলা ছোট ছোট সংলাপ,ডিটেইলসও যেন পরবর্তীতে কাহিনীর প্রয়োজনে হয়ে উঠেছে খুব অর্থবহ। এজন্যই ৪০০ পাতার বিস্তৃত এই কাহিনীর শেষে এসেও বলতে বাধ্য হতে হয়,লেখকের পরিমিতিবোধ অসাধারণ। 
প্রতিটা অধ্যায়ে অধ্যায়ে যে কবিতার দিয়ে শুরু হয়,সেগুলোর প্রাসঙ্গিকতা একে একে ধরা পড়ে কাহিনীর একদম শেষে গিয়ে। এজন্যই কাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেয়া এইসব কবিতা আরোপিত মনে হয় না।

❝সে কি রাত্রির শেষ মৃত পাখি, যার স্মৃতি আঁচড়াল
মৃত্যুর ঘন ছায়ায় দেবযান
ভয়ের মতন মৃদুসঞ্চারী স্বপ্নের পিছু নিতে?
স্বপ্নের মত আয়ু চলে যায়, কখনো বা দ্রুত, কখনো বিলম্বিতে।❞

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের লেখার স্বতন্ত্র স্বর, তীব্র কোলাহলের মাঝেও আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। কাহিনীর দৃশ্য হয়ে উঠেছে বাঙময়। অনেক সময় এমন হয় না,গল্পের পারিপার্শ্বিক পরিবেশও একটা গল্প বলে? ‘শেষ মৃত পাখি’ বইয়ে যে রকম বৃষ্টি হচ্ছে,আমার মনে পড়ে যাচ্ছে তুম্বাড় মুভির সেটের কথা। অনর্গল বৃষ্টি,বাইরেও বৃষ্টি,মুভির ভেতরেও বৃষ্টি,বইতেও বৃষ্টি। পাহাড়ি রাস্তার বাঁক,দূরে ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশা, আলো-আঁধারি, ম্যালে রঙবেরঙের ছাতা এক স্বপ্নালু ভাবাবেশ তৈরি করে। লেখার ডিটেইলিংস এতো নিখুঁত যে পড়েই পাঠকের মনে সেই দৃশ্যকল্পের নিজস্ব একটা ছবি তৈরি হতে থাকে,তারপর দৃশ্যায়নের রিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটার রেশ থেকে যায়। আবার পড়তে গিয়ে কখনো কখনো মনে হয়েছে সৃজিতের ‘বাইশে শ্রাবণ’ সিনেমার কথাও...

অনেকগুলো বছর পরে কর্নেল অরলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যখন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, তার মনে এসেছিলো বাবার সঙ্গে প্রথম বরফ দেখার স্মৃতি। আমিও সম্ভবত কখনো ভুলবো না। কুয়াশাটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে যাচ্ছে। কাঁপা ছবির মতো ভেসে উঠছে দূরের পাহাড়,জঙ্গল। বহু বহুক্ষণ নীরবে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। সারা গায়ে শিশির মেখে আবছা নিস্পন্দ একটা কালো ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে জলাপাহাড় রোডে। ঘাস খাচ্ছে না, শূন্য চোখে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সামনে। শরীরের একটা পেশিও কাঁপছে না। নড়ছে না লেজ। এক বিয়োগান্তক মহাকাব্যের অন্তিম দৃশ্য। 

❝শেষ মৃত পাখি❞ পাঠের এই অভিজ্ঞতাকে মনে রাখবো বহু বহুদিন, হয়তো বইটা পড়বো আরও বহু বহু বার। পাঠ অভিজ্ঞতার একটা স্থায়ী ছাপ আমার মনে অনুরণিত হতে থাকবে থেকে থেকে—

❝মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়... 
সূর্য যদি কেবলই দিনের জন্ম দিয়ে যায়,
 রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের, 
মানুষ কেবলই যদি সমাজের জন্ম দেয়, 
সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের, 
বিপ্লব নির্মম আবেশের,
 তা হলে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিল?❞

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।