ছায়াবৃতা।। সুনীল সেনশর্মা।।

জায়গাটার নাম ভালুকপং, চীন আক্রমণের পরে এই জায়গা থেকে উত্তরে বমডিলার দিকে উপদিষ্ট প্রণালী-মাফিক আধুনিক রাস্তা তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছিল। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে উপলবিক্ষতা জিয়া ভরেলী নদী। আমার থাকার তাঁবুটি নদীর প্রায় দশ ফিট উপরে এক প্রশস্ত সমতলভূমির এক প্রান্তে— ঝুঁকে তাকালে নীচে নদীর জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়।

পরদিন কাক-ভোরে ঘুম ভেঙে তাঁবুর এক চিলতে জানালার ফ্রেমে বাঁধানো আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। সারারাত বৃষ্টিস্নাত নির্মল ঘন নীল আকাশের এখানে-সেখানে পেঁজা তুলোর মতো এক এক টুকরো হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, কখনও ঘন সবুজে আচ্ছন্ন উঁচু পাহাড়ের নাগালের মধ্যে অবিশ্রান্ত কলস্বরে জিয়া ভরেলী তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। সুরের সেই মূর্ছনা দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে নীল আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের রাজ্যে তরঙ্গ তুলছে। এমন একটি অনির্বচনীয় মুহূর্তে তাঁবুর মধ্যে বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকা যায় না। বেরিয়ে এলাম।

জিয়া ভরেলী সত্যি জিইয়ে উঠেছে, উথলে উঠেছে। ওর পান্নার রঙে গেরুয়ার ছোপ লেগেছে। কালকের বৃষ্টির ফল। বিভিন্ন আয়তন ও অবয়বের শিলারাশি যুগ যুগ ধরে গড়িয়ে গড়িয়ে আদিরূপ ফেলেছে হারিয়ে। এখন সবই প্রায় গোলাকার— বিশাল শক্তির চাপে পড়ে নিজস্বতা, স্বকীয়তা এবং বৈশিষ্ট্য হারিয়ে সকলের সঙ্গে এক রূপ নিয়েছে। এই-সব শিলা রাশির উপর দিয়ে চঞ্চল গতিতে কখনও লাফিয়ে, কখনও প্রখর বেগে ভরেলীর জল বয়ে চলেছে। শীতে পান্নার রঙ— জলের আর বনানীর রঙ একাকার হয়ে যায়। বর্ষায় ভোল যায় পালটে, রঙ আর অবয়ব দুটোই। নদীর পারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দৃষ্টি বেশি দূর প্রবেশ করতে পারে না। অজানা রহস্যের ইঙ্গিত দিয়ে থেমে যায়।

হঠাৎ ওপারের জঙ্গল ভেদ করে কিছু জানান না দিয়ে বেরিয়ে এল দুটি মূর্তি। মূর্তিই বটে। ঘাঘরার মতো এক এক ফালি কাপড় কোমর থেকে সামনের দিকে নীচে ঝুলে রয়েছে। একটু তামাটে রঙ— মাথার উপর কৃষ্ণের চূড়ার মতো ঝুঁটি বাঁধা চুল, থুতনিতে ঠোঁটের নীচ থেকে নেমে গেছে দুটি কালো উল্কির রেখা। হাতে একটি করে ধনুক, কোমর থেকে ঝুলছে এক একখানা করে দা। পিঠে তৃণের মধ্যে গোঁজা কয়েকটি তীর। ঠিক যেন মহাভারতের পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে আসা দুই যোদ্ধার মূর্তি।

অবাক হয়ে দেখছিলাম। পরিবেশের জন্যই বোধ হয় ভয় পেতেও ভুলে গিয়েছিলাম। জনবহুল এই ক্যাম্পের মধ্যে— কয়েক শো ফুট দূরে না থাকলে হয়তো প্রচণ্ড রকম ঘাবড়েই যেতাম। কারণ, আমাদের সাধারণ বিশ্বাস আদিবাসী, বিশেষ করে এই অঞ্চলের আদিবাসীরা হয় মানুষখেকো, নয়তো স্বভাবে এমন যে, বাইরের কোনো লোকের অনধিকার প্রবেশকে সহজে ওরা বরদাস্ত করে না। এককালে শেষোক্ত অবস্থা সত্যি ছিল। হঠাৎ পিছনে আওয়াজ পেলাম ‘এরা এই অঞ্চলের পার্বত্য জাতি— আকা' — ইঞ্জিনিয়র গুপ্তার গলা। আকা তো নিশ্চয়ই— প্রকৃতির অপরূপ পটে নিপুণ শিল্পীর আঁকা ছবির মতোই। শুনেছি এবং পরে দেখেছি অনেকবার। এরা সব সময়ই কিছু-না-কিছু অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করে। বনে-জঙ্গলে আত্মরক্ষার প্রয়োজন অন্তত রয়েছে।

ভালুকপং থেকে বমডিলার দূরত্ব প্রায় একশো পঁচিশ কিলোমিটার, উচ্চতার ফারাক প্রায় তিন হাজার মিটারের মতো। বমডিলার দক্ষিণে পাহাড়ের শ্রেণীর শুরু পর্যন্ত এই অঞ্চলে আকাদের বাস। এরা খুব উঁচু পাহাড়ের উপর থাকে না, কোনো উপত্যকায় বা তার কাছাকাছি এদের আস্তানা। দু-একটি গ্রাম ছাড়া আমার যাবার পথে আমি আকাদের গ্রাম খুব কমই দেখেছি। হতে পারে রাস্তার নকশা স্থির করার সময় অনিবার্য কারণে গ্রামগুলি দূরে পড়ে গেছে।

আমি আকাদের সম্বন্ধে যেটুকু শুনেছি বা পড়েছি, তা খুবই চিত্তাকর্ষক। প্রকৃতপক্ষে প্রায় সব আদিবাসীর ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য— আকারা কিন্তু নিজেদের বলে ‘হুসো’। ওরা মনে করে বহু প্রাচীনকালে ওদের আদি বাসস্থান ছিল বিশ্বনাথের (তেজপুরের উত্তরে পাহাড়ী স্থান— তেজপুর থেকে নর্থ লখীমপুর যাবার রাস্তায় পড়ে) উত্তরে শীলাধারী নদীর তীরে। একসময় শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম ওদের বিতাড়িত করে নেফার পার্বত্য অঞ্চলের দিকে। সত্যতার যাচাই করার উপায় জানা নেই আমার। তবে মনে হয় এই বিশ্বাসের মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে বিজিত এবং বিজেতার ক্ষমতার লড়াইয়ের। 


ছায়াবৃতা
সুনীল সেনশর্মা

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সৌজন্য চক্রবর্তী 
মুদ্রিত মূল্য: ২৫০ টাকা

#সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।