বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ' বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য ' পড়ে লিখেছেন শুভ রায়চৌধুরী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
....................................
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য-এর 'শেষ মৃত পাখি' পড়ার পর দ্রুত 'একানড়ে' পড়ে ফেলেছিলাম। এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবজিনে ওঁর বেশকিছু লেখালিখি পড়েছি। প্রথমেই জানিয়ে রাখি, এই সময়ের লেখকদের মধ্যে শাক্যজিৎ আমার অন্যতম পছন্দের নাম, কারণ তিনি নিরীক্ষামূলক গদ্য লিখতে পছন্দ করেন। তাই প্রতিক্রিয়া লিখতে বসে কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারলাম সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। চেষ্টা করেছি ভালো বা মন্দের মধ্যে না ঢুকতে।
সমাজমাধ্যমে বইটির টুকরো-টুকরো সামারি পড়ে আমার প্রথমেই একটা ধারণা হয়েছিল যে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর 'ক্রনিকল অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড'কে (১৯৮১) মনে করাবে। বইটি হাতে নিয়ে পড়া শুরু করার পর সে-ধারণা সত্যি হয়েছে, যদিও আঙ্গিকগত সামান্য মিল থাকলেও, উপন্যাস দুটির কম্প্যারাটিভ আলোচনা এই স্বল্প পরিসরে নিষ্প্রয়োজন। তবে, পাঠ চলাকালীন আমি বার বার গার্সিয়া মার্কেসের লেখার স্বাদ পেয়েছি। ব্যস, এইটুকু।
কাহিনির সূত্রপাত হয়েছে এক ভোরে। গ্রামের বলখেলার মাঠে বটগাছ থেকে ঝুলতে দেখা যায় একটা লোককে। লোকটিকে সবাই চেনে– বীরেশ্বর সামন্ত। ক্রমে লোকজন জমা হয় ঝুলন্ত মৃতদেহকে ঘিরে। তাদের অনেকেই জানে কে বা কারা খুন করে বীরেশ্বর সামন্তকে ফাঁসির দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। এরপর আমরা জানতে পারি, এই খুনের পেছনে থাকা সুদীর্ঘ ইতিহাস ও কোন কোন চরিত্রের কী কী উদ্দেশ্য ছিল। এটা যদি মূল আখ্যানবস্তু হয়, এর পাশাপাশি সাব-প্লট হিসেবে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। এসেছে তেভাগা আন্দোলনের কথা, লাল পার্টির উত্থান-লড়াই এবং তারও পরে নাম না-করে বর্তমানের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা। আর গল্পের আবর্তন দুটি পরিবারকে ঘিরে— সামন্ত (শাসক ও অত্যাচারী) ও বাগাল (শোষিত ও নিপীড়িত)।
আখ্যানবস্তু নিয়ে এর থেকে বেশি লেখার দরকার নেই, কারণ আখ্যানের বয়ান এই উপন্যাসে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। বয়ান নন-লিনিয়ার অর্থাৎ আদিমধ্যঅন্ত এই হিসেব মেনে চলেনি, বরং গুরুত্ব পেয়েছে চরিত্র ও ঘটনা পরম্পরার ক্যাথারটিক মূল্যায়ন। কাহিনির প্রারম্ভ, অধোগতি ও সমাপ্তি পাঠক শুরুতেই মোটামুটি আন্দাজ করে ফেলেন। এবার কাহিনির কমপ্লিকেশন ও ডেভেলপমেন্ট অর্থাৎ রাইজ অফ অ্যাকশন-এর জন্য পাঠককে প্রতিটি চরিত্রের নামাঙ্কিত অধ্যায়গুলোতে প্রবেশ করতে হয়। এখানেও সময় একটা অন্যতম ডিভাইস, যেটা নন-ক্রোনোলজিক্যাল, কারণ কাহিনি শুরু হচ্ছে বর্তমান কাল-এ এবং চরিত্রগুলোর ইতিহাস না-জানলে বীরেশ্বর সামন্ত কেন খুন হলেন সেটা স্পষ্ট হয় না। তখন পাঠককে বর্তমান থেকে একেবারে অতীতে ফিরে যেতে হয়, আর প্রতিটি চরিত্রের ক্ষেত্রে আলাদা-আলাদাভাবে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসতে হয়। সময়ের মধ্যে দিয়ে এই যাওয়া-আসার জন্য কাহিনির গতি কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। রহস্য গল্পের ক্ষেত্রে সাধারণত যে'রকম গতিময়তা গদ্যে দেখতে পাই, এই উপন্যাস যেন সেটা প্রথম থেকেই প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছে (উল্লেখ্য, দীর্ঘ বাক্য ও দৃশ্য-পরিসর-চরিত্রদের মনস্তত্ত্বের বর্ণনা অনেক সময়ই গতিকে মন্থর করেছে; আর গোটা উপন্যাসে সংলাপ প্রায় নেই বললেই চলে)। এভাবেই উপন্যাসটির বয়ান অন্যান্য রহস্য কাহিনির থেকে ভিন্নধর্মী হয়ে উঠেছে। প্রতিটি চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বজ্ঞ লেখক হত্যার উদ্দেশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। সুতরাং প্রতিটি চরিত্রের আলাদা আলাদা এক-একটা গল্প, শেষে একটা বিন্দুতে (সমাপ্তি) গিয়ে মিলিত হয়ে মেটা-ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে খুন-পর্বটি পুনর্গঠিত হয়। এছাড়া কিছু ছোট ছোট ঘটনাও বিভিন্ন চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে নতুন একটা ধারণা তৈরি করে। অর্থাৎ, উপন্যাসের শৈলীটি নিজেই একটি অপরাধকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির একটি আনুষ্ঠানিক পুনরাবৃত্তি। এই পুনরাবৃত্তি বয়ানের জটিলতা বা গোলকধাঁধা কিছুটা বাড়িয়েছে বই-কি! পড়তে পড়তে এই চ্যালেঞ্জ ক্রমশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল।
মোটিফ হিসেবে ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর ব্যবহার দেখা যায় চরিত্রগুলোর বিশদ অ্যানেকডোটাল ডিগ্রেশন ও বিশদ বর্ণনার জন্য। যেমন, নকুল কাঁটালের স্বপ্ন বা ভীমের সঙ্গে কথোপকথন, সামন্তদের পূর্বপুরুষদের মাটি খাওয়া ইত্যাদি।
উপন্যাসটি শেষ হয়েও পাঠককে বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা নিয়ে সব উত্তর দিয়ে যায় না, পাঠককে বিভ্রান্ত করে তোলে এবং ভাবতে বাধ্য করে। চরিত্র-নামাঙ্কিত প্রতিটি অধ্যায় শেষে পাঠকের মনে হবে এই বুঝি রহস্যের উন্মোচন হচ্ছে, কিন্তু সেটা কিছুতেই হয় না। ক্লোজার সাধারণত অন্য রহস্য উপন্যাসের মতো কিছু নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে শেষ হয় না, বরং একটা এপিগ্রাফ দিয়ে শুরু করে চিন্তার জন্য খোলা পরিসর পাঠকের জন্য ছেড়ে রাখে। পাঠক চাইলে উপন্যাসটিকে মিখাইল বাখতিন-এর পলিফোনি-র ধারণা দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতে পারেন যেখানে চরিত্রগুলি প্রকাশ পায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের উন্মোচনের মাধ্যমে।
যা-ই হোক, উপন্যাসটি যে তথাকথিত রহস্য কাহিনি নয়, সেটা লেখক নিজেই জানিয়ে রেখেছেন। অপরাধ ও অপরাধী এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং ঘটনার শেকড়টাকে বুঝতে পারা উপন্যাসের আসল উদ্দেশ্য। রহস্য কাহিনির ভিড়ে এই অভিনবত্ব অবশ্যই বইটিকে আলাদাভাবে খুঁজে নিতে সাহায্য করে।
বলেছিলাম ভালোমন্দের কথা বলব না। কিন্তু একেবারেই না বললে আমার মতো বাঙালি পাঠকের প্রতিক্রিয়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ভালো: প্রচ্ছদ। সৌজন্য চক্রবর্তী'র প্রচ্ছদ সবসময়ই পাঠককে আকর্ষণ করে। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।
মন্দ: সামান্যই। কিছু মুদ্রণ ত্রুটি চোখে পড়েছে (নোট রাখিনি, তাই হাইলাইট করতে পারব না)। আশা করছি পরবর্তী সংস্করণে ঠিক করে নেওয়া হবে।
° বই: বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য
° লেখক: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
° প্রচ্ছদ: সৌজন্য চক্রবর্তী
° প্রকাশক: সুপ্রকাশ
° মুদ্রিত মূল্য: ৪৮০/-
Comments
Post a Comment