নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত অলোক সান্যালের উপন্যাস 'নষ্ট চাঁদের আলো' পড়ে লিখেছেন সৌরজিৎ বসাক। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
...................................

পাঠ প্রতিক্রিয়া - 
🔺বইয়ের নাম : নষ্ট চাঁদের আলো 
🔺লেখকের নাম : অলোক সান্যাল 
🔺প্রকাশক : সুপ্রকাশ
🔺মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা

এই বছরের গোড়ার দিকেই রবার্ট লুই স্টিভেনসনের "ট্রেজার আইল্যান্ড" পড়ার সময়ে মনে হয়েছিল যে বাংলা ভাষায় জলদস্যু বিষয়ক ম্যাচিওর প্যালেটের কোন কাজ হলে বেশ একটা ভালো ব্যাপার হবে। এরকম সময়ে গত পয়লা বৈশাখ নাগাদ সুপ্রকাশ প্রকাশনার পেজে আলোচ্য বইটির প্রথম টিজার দেখে যারপরনাই ভালো লেগেছিল। সদ্যপ্রকাশিত কোন বইয়ের ক্ষেত্রে এতটা আগ্রহ এর আগে জেগেছে বলে মনে পড়ছে না। চাহিদা মতোন বিষয়ের উপর লিখিত হওয়ার পাশাপাশি, সৌজন্য চক্রবর্তীর করা সুদৃশ্য প্রচ্ছদটিও বইটির সম্বন্ধে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য অনেকাংশে দায়ী। 

প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে ৩৯৭ পাতার এই সুবিশাল উপন্যাসটিকে একটিমাত্র জ্যঁরে ক্লাসিফাই করা খুবই কঠিন। সামাজিক, ঐতিহাসিক, থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্চার - এই চারটি জ্যঁরের উপাদানই এই বইয়ে সহাবস্থান করছে। জলদস্যু, গুপ্তধন ইত্যাদির কথা শুনে একটা রোমাঞ্চে ভরপুর আদ্যপ্রান্ত টানটান লেখা আশা করে এই বই পড়তে শুরু করলে হতাশ হতে হবে।
তার কারণ ব্লার্বেই সুস্পষ্টভাবে দেওয়া রয়েছে। জলদস্যুর মতোন রোমাঞ্চকর বিষয়ই এই কাহিনির একমাত্র উপজীব্য বিষয় নয়, আঠারো শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশদের কর্তৃক আফ্রিকা এবং আমেরিকান কলোনিতে ঘটিয়ে চলা অরাজকতাও এই বইয়ের কাহিনি পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছে।

বইটির কাহিনি মাল্টিপল টাইমলাইন ন্যারেশনের ভিত্তিতে এগিয়েছে। একটি টাইমলাইন আঠারো শতকের আরেকটি টাইমলাইন বর্তমান সময়ের। 

আঠারো শতকের টাইমলাইনের কাহিনি আফ্রিকার স্লেভ কোস্টের এক মর্মান্তিক ঘটনা থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ তা গিয়ে মিশেছে এই কাহিনির স্পটলাইট যার উপর অর্থাৎ আটলান্টিক দাপিয়ে বেড়ানো জলদস্যু ব্ল্যাকবিয়ার্ডের উত্থান এবং অন্তিম পরিণতির সঙ্গে। এরই সঙ্গে ব্রিটিশ রাজশক্তির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন এক ব্যক্তি "স্যার পিটার" কীভাবে আমেরিকান নেটিভদের প্রতি আবেগতাড়িত হয়ে ব্রিটিশবিরোধী "রেবেল পিটার" হয়ে গেলেন তার এক মার্মিক কাহিনি। 

বর্তমান সময়ের টাইমলাইনের কাহিনি এগিয়েছে বহু সময় আগে বিলুপ্ত (বর্তমানের নিরিখে) সেই ব্ল্যাকবিয়ার্ড জলদস্যুর জাহাজ কুইন অ্যানি'স রিভেঞ্জের ধ্বংসাবশেষ এবং ব্ল্যাকবিয়ার্ডের গুপ্তধন খুঁজে বার করার এক সমুদ্র-ভিত্তিক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানের মাধ্যমে। অভিযানের নেতৃত্বে মেরিন আর্কিওলজিস্ট ড. এমা মিলারের সাথে জড়িয়ে পড়া আরও কিছু মানুষ, যাদের মধ্যে কেউ ভালো আবার কেউ মন্দ, তাদের সবাইকে নিয়ে এক রুদ্ধশ্বাস অ্যাডভেঞ্চার গড়ে উঠেছে বর্তমান টাইমলাইনে। ষড়যন্ত্র, কন্ট্র‍্যাক্ট কিলার, ট্রেজার হান্টিং, পাজল সলভিং ইত্যাদি বিষয় থাকায় জন্যই বর্তমান টাইমলাইনের কাহিনিতে থ্রিলার-অ্যাডভেঞ্চারের ছোঁয়া লেগেছে। 
অবশ্য অতীতের টাইমলাইনে যতবার ব্ল্যাকবিয়ার্ড নিজের "সমুদ্রের শয়তান" রুপে অবতীর্ণ হয়েছে ততবারই দ্রুত পাতা উলটানোর মতোন থ্রিলিং উপাদান বেশ ভালোমতোনই মিলেছে।

এতকিছুর পরেও এই উপন্যাসটিকে পুরোপুরি থ্রিলার গোত্রে ফেলে দিতে মন সায় দেয় না। গল্পের পরতে পরতে, অতীতে ইংল্যান্ড কর্তৃক "আফ্রিকান স্লেভ কোস্ট - আমেরিকান কলোনি - ইংল্যান্ড" এই তিন বিন্দুতে গড়ে তোলা ত্রিমুখী বাণিজ্য এবং তার আনুষঙ্গিক বর্বরতা এত সুস্পষ্টভাবে লেখক তুলে ধরেছেন যে বইটির বিষয় সংক্রান্ত প্যালেটটি অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক কার্যকলাপ আমাদের নিজের দেশে আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখলেও, আফ্রিকা কিংবা আমেরিকান কলোনিতে সেটি কীভাবে এবং কতদূর নিজের করালগ্রাস বিস্তার করেছিল তা এই বইয়ের কাহিনি সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিতে সক্ষম।
কাহিনির হাইলাইট যে জলদস্যুরা, তাদেরও জলদস্যুতায় নাম লেখানোর পেছনে স্থলভাগের রাজনীতি কীভাবে দায়ী তাও বলা হয়েছে এই আখ্যানে। 

আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ঔপনিবেশিক রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা, বর্ণবিভেদ, জাতিবিভেদ, ক্ষমতার দম্ভ ইত্যাদি বিষয়গুলির বিস্তারিত বর্ণনা থাকার দরুণই এই বইটিকে একচেটিয়া থ্রিলার কিংবা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি বলা চলে না। জমকালো বিষয়ের টানটান ঘটনার পাশাপাশি এই বই এমন অনেক রসদই পাঠককে জোগাতে সক্ষম যা দীর্ঘস্থায়ী দাগ কাটবে মনে। 

আরেকটা বিষয় যেটা ভালো লেগেছে তা হল - ড. এমা মিলারের পাশে সমস্ত অভিযানে তার ভাই এমিলের সঙ্গ দেওয়া। ভাইবোনের দুষ্টু-মিষ্টি সম্পর্ক একটা রিফ্রেশমেন্ট এনেছে কাহিনি পাঠের সময়ে। নাহলে এইক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়ই একটা গতানুগতিক প্রেমের সম্পর্ক ঢুকিয়ে দেওয়া খুবই সাধারণ বিষয়। প্রেমের বিষয়টি ইন্ট্রোডিউস করেও ভাইবোনের সম্পর্কের উপর বেশি জোর দেওয়ায়, বর্তমান টাইমলাইনের কাহিনি স্বাতন্ত্র্য পেয়েছে অনেকাংশে। প্রেম-ভালোবাসার বিষয় অবশ্য সম্পূর্ণ অধরা নেই কাহিনিতে, অতীতের টাইমলাইনের কিছু অংশে এটিও স্বমহিমায় বিদ্যমান। তবে সেটিও কাহিনির গুরুত্বপূর্ণ অংশ, শুধুমাত্র স্পাইস-আপ করার খাতিরে লেখা নয়।
এই একই সূত্রে একটি পুনর্জন্ম সংক্রান্ত স্টোরি-আর্কও মিলবে দুই টাইমলাইনের সন্ধি হিসেবে। 

এতকিছু আলোচনা করার পরে এটা বলাই চলে যে লেখক এই বইটিতে বিষয়-বৈচিত্র‍্যের ব্যাপারে দুইহাত উপুড় করে দিয়েছেন। কিন্তু সবগুলোই সুষ্ঠুভাবে সহাবস্থান করতে সক্ষম, জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে। 

বইটির মেকিংও চমৎকার। প্রচ্ছদ নিয়ে আগেও বলেছি। এছাড়া বইটির দুইদিকের পুস্তানিতেই রয়েছে একটি ম্যাপের ছবি যা কাহিনিতে বর্ণিত ইংল্যান্ডের ত্রিমুখী বাণিজ্যের গতিপথ ভিজ্যুয়ালাইজ করতে সাহায্য করে। বেশ কিছু অলংকরণও রয়েছে বইটিতে।

সবশেষে এটাই বলার - যাঁরা গল্পের ছলে ইতিহাস জানতে ভালোবাসেন, যাঁরা সামাজিকতার দৃষ্টিকোণে মার্মিক কিছু পড়তে ভালোবাসেন অথবা যাঁদের আমার মতোন জলদস্যু বিষয়টিকে বেশ আকর্ষণীয় বলে মনে হয় তাঁদের সবার জন্য লেখা একটি বই এটি। কাহিনির ঘটনাক্রম হয়তো কিছু সময় পর স্মৃতি থেকে আবছা হয়ে যাবে কিন্তু মাগাভা, আফ্রেয়া, রেবেল পিটার, আইয়ানা, ব্ল্যাকবিয়ার্ড, থমাস, ফিলিপ, ফাদার সাইমন, এমা, এলিন ইত্যাদি চরিত্রগুলির কথা মনে রয়ে যাবে অনেকটা সময়। সবকিছুই বড্ড জীবন্ত।

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।