মরুনির্ঝর।। সূর্যনাথ ভট্টাচার্য।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত সূর্যনাথ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'মরুনির্ঝর' পড়ে লিখেছেন সায়ন কুমার দে। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
......................................................................
সূর্যনাথ ভট্টাচার্যের 'মরুনির্ঝর' ঐতিহাসিক উপন্যাস, তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসত্রয়ের শেষতম বই। বইটি প্রকাশ পেয়েছে সুপ্রকাশ প্রকাশনী থেকে, অসামান্য এক ধ্রুপদী প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন শিল্পী সৌজন্য চক্রবর্তী।
এই উপন্যাসটি বিশাখদত্ত রচিত সংস্কৃত নাটক মুদ্রারাক্ষস আধারিত। আধারিত বা অনুপ্রাণিত হলেও এই উপন্যাস মুদ্রারাক্ষসের অনুবাদ বা নবনির্মাণের প্রয়াস নয়। নাটকের সময়কাল, কয়েকটি ঐতিহাসিক-অনৈতিহাসিক চরিত্র ও কিছু ঘটনাকে ব্যবহার করে 'মরুনির্ঝর' উপন্যাসটির কাহিনী নির্মাণ করেছেন লেখক। আধারে তাই অনুসরণ থাকলেও, আখ্যান ও চিত্রবিন্যাস লেখকের নিজের। মূলত মহারাজ নন্দ ও তাঁর মহামর্ত্য কাত্যায়ন বা রাক্ষসের অনাবিষ্কৃত পারিবারিক পরিসরে বর্তমান কাহিনীর সঞ্চরণ। কিন্তু আখ্যানের পরম্পরায় মূল নাটক মুদ্রারাক্ষসের কাহিনির বিরোধ সৃষ্টি হয় নি, দুটি আখ্যানধারা যেন পারস্পরিক অবলম্ব বিস্তৃত ৷ উপন্যাসটিতে ইতিহাসের অমীমাংসিত এক প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক, তারজন্য আখ্যান বিন্যাসে কিছুটা স্বাধীনতা নেওয়া হয়েছে। মগধ সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জন্মরহস্য ও কুলপরিচয় নিয়ে বেশ কিছু মতবাদ আছে । এক জায়গায় বলা হয়েছে, তিনি মেষপালকের পুত্র। অন্যত্র তাঁকে নন্দবংশজাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বয়ং মহারাজ ধননন্দ নাকি তাঁর পিতা। যদিও মুরা পুত্র চন্দ্রগুপ্ত নিজেকে মাতৃপরিচয়ে পরিচিত করে গেছেন ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু কেন এই স্ববিরোধ ? কী হতে পারে প্রকৃত সত্য ? ইতিহাসে সঞ্চিত নেই এসব প্রশ্নের উত্তর। নন্দবংশের সমাপ্তি ও মৌর্যশাসন প্রতিষ্ঠার যুগসন্ধিক্ষণে চন্দ্রগুপ্তের কুলপরিচয় অন্বেষণের প্রচেষ্টায় উপন্যাসে আছে এক সম্ভাব্য সমাধানের ইঙ্গিত। তার ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তা লেখকের কল্পনা ও যুক্তিসিদ্ধ অনুমান। এই অনুসন্ধান আখ্যানকে করেছে আকর্ষণীয়, উপন্যাসের যুক্তিতে সবল, তাতে ইতিহাস নেই... আছে ছিন্ন কিছু সূত্র ধরে ধরে বয়ন প্রচেষ্টা।
"তথাগত বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের পর শতাধিক বর্ষ অতিবাহিত। সম্রাট বিম্বিসার-খ্যাত হর্ষঙ্ক বংশের অন্তিম পুরুষ মহানন্দিন মগধের অধিকার হারিয়েছিলেন শিশুনাগ বংশপতি শুশুনাগের দ্বারা। এই নৃপতির ধারাই তখন উত্তরভারতের সবচেয়ে উজ্জ্বল রাজবংশ, যদিও তা দীর্ঘায়ু হয়নি। শেষ শিশুনাগ নরপতি নিহত হলেন মহানন্দিনের ঔরসজাত দাসীপুত্র মহাপদ্মনন্দের হাতে । মহাকালের বিধানে সমাপ্ত হয়েছিল এক ঐতিহাসিক প্রতিশোধ চক্র ।
উগ্রসেন মহাপদ্মের শোণিতে নিম্নবর্ণের মিশ্রণ, কিন্তু বাহুতে ছিল রাজরক্তের শৌর্য। তিনি অসাধারণ যোদ্ধা ছিলেন, পরশুরামের মতো ক্ষয়িত্রশূন্য করেছিলেন সমগ্র উত্তর ও মধ্য ভারতকে, যার মধ্যে ছিল ঈক্ষাকু, পাঞ্চাল, হেহয়, একলিঙ্গ, শূরসেন ও মৈথিলির মতো প্রতিষ্ঠিত রাজবংশগুলি ।
সূত্রপাত হয়েছিল নন্দবংশের, আগামী অর্ধশতাব্দীর জন্য ভারতের ইতিহাস রচনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। মহাপদ্মের মগধকেন্দ্রিক সাম্রাজ্য ক্রমে আয়তনের বিশালতায়, রণশক্তির পরাক্রমে ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে সমস্ত প্রতিবেশী রাজ্যের মিলিত বিরোধীশক্তিকে পরাভূত করেছিল।"
এই উপন্যাসের সময়কাল ঠিক তার পরবর্তীকালের, ভারতের উত্তরভাগে তখন গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের রণশিবির, মগধের সিংহাসনে নন্দবংশের ইন্দ্রিয়াসক্ত অযোগ্য রাজা ধননন্দ আসীন। অত্যাচারী এই রাজার রাজধর্ম পালনে দমনকার্যই প্রাধান্য পেয়েছিল, ফলে প্রজা অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। মহামর্ত্য কাত্যায়ন রাজ্যের দায়ভার পালন করতেন। ধননন্দের ভ্রষ্ট জ্ঞানসভায় অপমানিত এক উজ্জ্বল মেধাবী ব্রাহ্মণ চণকপুত্র বিষ্ণুগুপ্ত প্রতিজ্ঞা করেন নন্দবংশ বিনাশের। তাঁর প্রয়াসে অতঃপর আর্যাবর্তের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন জনৈক নামগোত্রহীন যুবক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, যিনি স্বপ্ন দেখতেন বিদেশী শক্তির সহায়তায় নন্দবংশ নির্মূলের। পরবর্তীকালে চন্দ্রগুপ্তের সহায় হন তিনি ও নন্দবংশ উৎখাত করে স্থাপন করেন মৌর্য সাম্রাজ্য।
এই উপন্যাসে ঐতিহাসিক সত্যের পাশাপাশি বয়ে চলেছে ঔপন্যাসিকের আখ্যান। উপন্যাসে আছে এক বিরলতম ও অধুনাবিস্মৃত রাগ মরুনির্ঝর-এর কথা। এই রাগিণী সুরে সুরে বহন করছে মানুষের চিরন্তন বিচ্ছেদ ও বিরহের সুর। সঙ্গীতাচার্য মরুধর ও কাত্যায়নকন্যা নির্ঝরিণী এই দুই মানুষ-মানুষীর মিলনে সৃষ্ট এই রাগ। তারপর কীভাবে সেই রাগিণী জড়িয়ে গেল মহাকালখণ্ডের মহাসন্ধিক্ষণে নন্দ-মৌর্য রাজনৈতিক পালাবদলের ঘটনাপ্রবাহে তাই নিয়েই 'মরুনির্ঝর'-এর আখ্যান। সে নিয়তিক্রমে জড়িয়ে পড়ে ধননন্দ কন্যা ধৃতি ও কাত্যায়ন কন্যা নির্ঝরিণী। আর তাদের সঙ্গেই নির্ধারিত হয় শ্রেষ্ঠীপুত্র বিরাবান ও তারই বন্ধু ভাস্কর্যশিল্পী অরণ্য-এর ভবিষ্য। আর এইভাবে কালের মন্দিরায় কীভাবে যেন বেজে উঠল হিংসা, বিদ্বেষ, সংঘাত, প্রেম ও সুরের আশ্চর্য সঙ্গীত, যা
নন্দ ও মৌর্য বংশের যুগসন্ধির পটভূমিকায় গভীর মানবিক টানাপোড়েনে উৎপন্ন কিছু বিপন্ন মানুষের জীবনের, মননের রক্তাক্ত ইতিবৃত্ত। তাই এই উপন্যাস শুধুমাত্র রাজবংশের পটপরিবর্তনের ইতিহাস নয়, ষড়যন্ত্র ও গুপ্তহত্যায় আকীর্ণ এক নগরীর উপকথাও নয়... ঔপন্যাসিকের কল্পনায় জারিত এক বাস্তবসদৃশ উপাখ্যান। তাতে মিশে আছে সাহিত্যের নবরস, নিপুণ চরিত্র নির্মাণ ও বিন্যাস, কাহিনির ঘটনাপরম্পরার দক্ষ বুনোট। উপন্যাসটির শুরুতে ও শেষে যে ঘটনাক্রম উল্লেখ করেছেন লেখক প্রবেশক ও পরিশিষ্ট হিসেবে তা ইঙ্গিতপূর্ণ, ভিন্নতর প্রকাশেও তা লেখা হতে পারতো, নিরস তথ্যসূত্রের উল্লেখে... কিন্তু লেখকের এই স্বাধীনতাকে মেনে নিলাম পাঠক হিসেবে।
______________________
মরুনির্ঝর
সূর্যনাথ ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment