অবিকল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।। শতঞ্জীব রাহা।। সুপ্রকাশ।।

'বর্ষার মাঝামাঝি।'—এই অসম্ভব কর্তিত-বাক্যটি দিয়ে পদ্মানদীর মাঝি-র সূচনা হয় একেবারে পদ্মানদীর মাঝ-গাঙে।—প্রথম অনুচ্ছেদেই সারা রাত জেগে থাকে পদ্মা। আর পদ্মার বুকে জেগে থাকে মাছমারাদের দল। তাদের মধ্যে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কুবেরের দেখাও পাওয়া যায়। পদ্মার জলপ্রবাহের মতো তাদের জীবনের নিরন্তর প্রবাহ সময়-পরিবর্তনের সঙ্গী হয়ে একটি-দুটি অনুচ্ছেদেই যেন সমগ্রতা পায়: দিন কেটে যায়। জীবন অতিবাহিত হয়। ঋতুচক্রে সময় পাক খায়। পদ্মার তীর ভাঙে, তীরের মাটি ধ্বসে। পদ্মা নিজের বুকের মাঝখানে চর গড়ে তোলে। আবার অর্ধ- শতাব্দীকাল পরে সেই চর পদ্মার নিজের জলেই বিলীন হয়ে যায়। পদ্মা তাই ভাঙা- গড়ার কারিগর।

পুতুলনাচের ইতিকথার তুলনায় এই উপন্যাসের কাহিনী বলয়ে ঋতুকাল ঈষৎ সংকীর্ণ হলেও সময়ের গতিশীলতাকে বেশ বোঝা যায়—কখনও ঋতুর উল্লেখে, কখনও মানুষের যাপনের অনুষঙ্গে, কখনও উৎসব-পার্বণের সমাগমে বা অন্য-কোনো উপায়ে তা জ্ঞাপিত হয়।

আশ্বিনের ঝড় বা কালবৈশাখী জেলেপাড়ার মানুষগুলিকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের ঘর ভাঙে—গাছ চাপা পড়ে আমিনুদ্দির বউ ছেলে মারা যায়, কুবেরের মেয়ে গোপি আহত হয়। বর্ষার দিনে ঘরে জল ঢোকে, শীতের কনকনানি মানুষগুলোর হাড়ে গিয়ে বাজে। পুতুলনাচের ইতিকথা-র মতোই এখানে ঋতুচক্রের চলনের সঙ্গে সঙ্গে আসে নানাবিধ রোগ, আসে শোক। আবার প্রকৃতির আশ্রয়েই, একান্ত নির্ভরতায় 'ক্ষুধাতৃষ্ণার দেবতা'র সঙ্গে মানুষগুলির মরণ-বাঁচন বোঝাপড়া চলতেই থাকে: 

সকলেই লক্ষ্য করেছেন যে, এই উপন্যাসের কেন্দ্রে থাকা চিরপ্রবহমানা, চিরকাল নিজের বুকের জলতলে মাটির পৃথিবীকে লুকিয়ে রাখা, চির-পালিকা, চির-রহস্যময়ী, 'সমন্দুর' পর্যন্ত বিস্তৃত পদ্মাই পাড় বা চরের মতো দুপাশের মানুষের জীবন, জীববৈচিত্র্যের জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে—জীবিকা ও জৈবিকতায়ও তার প্রভাব সর্বব্যাপ্ত। উপন্যাসটি নদী-জীবনেরই আখ্যান হয়ে ওঠে যেন।
শীতের বিকালে পদ্মার ঘাটে কুবের নৌকার তদ্বির করতে যায়—এ তো জেলে-মাঝিদের জীবিকার্জনের নৈমিত্তিক কাজ। কিন্তু আজ কুবেরের মন কেমন করতে থাকে কপিলার জন্য। প্রায় স্বপ্ন বা নিদ্রা-ভ্রমণে সে পদ্মার তীরের ফাটল-ধরা অংশগুলির মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে একসময় মাটিসমেত পড়ে যায়, একটু আহতও হয় : 
তারপর কষ্টে উঠিয়া সে নিঝুম হইয়া থাকে—শেষবেলার সূর্যে যেন পদ্মাকেও নিঝুম করিয়া দিয়াছে, দূরের নৌকাগুলি এবং আরও দূরের স্টীমারটি যেন হইয়া গিয়াছে গতি-হারা। বাতাসের জোর নাই, নদীর ছলাত ছলাত শব্দ যেন ক্লান্ত।

মানিক পদ্মার শরীর জীবনপ্রবাহের ছবি আঁকেন পুতুলনাচের ইতিকথা-র প্রকৃতিচিত্রের মতোই ছোটো ছোটো আঁচড়ে—এখানে তা অঙ্কিত হয় ঈষৎ চওড়া রেখায়, কালির ঘনত্বও থাকে বেশি। তিনি সরাসরি বিবৃতির মধ্যে দিয়ে জীবন ও জৈবিকতার ছবিটিকে একাধারে স্পষ্ট করে তোলেন ও অতিমাত্রায় সংক্ষিপ্ত করে দেন:

শুধু নদীনির্ভর ধীবর, মাঝি, নদীবাহনে যাতায়াতকারী মানুষজন, নদীলগ্ন নানাবিধ পেশাজীবী মানুষই নয় পুতুলনাচের ইতিকথা-র মতো এই উপন্যাসেও প্রগাঢ় রেখায় মানিক এঁকে তোলেন জীবন ও নিরন্তর জীবিকা-অন্বেষণের ইতিবৃত্তকে—মাছরাঙার জলে ছোঁ-মেরে শিকার করা, কাউয়াচিলা পাখিদের ক্রমাগত জলে ঝাঁপিয়ে পড়া, বকেরা নদীর জলে একক শিকারী—ইত্যাদি ইত্যাদি।

পদ্মার ক্রোড়ে লালিত মাঝিদের সদর-অন্দরের পরিচয়ও মানিক দেন সবার অ-লক্ষ্যে, একটিমাত্র বাক্যাংশে অথচ মোক্ষম সে পরিচয়: 'পদ্মার বুকে নৌকা ভাসাইয়া যাহারা ভাবুক কবি, ডাঙায় যাহারা গরীব ছোটলোক' তাদের বুঝে ওঠা মেজবাবু কেন পাঠক হিসেবে আমাদের পক্ষেও সহজ নয়। বস্তুত উপন্যাসে নদী আর জীবনের অচিহ্নিত মিলনরেখাটিকে মানিক একেবারে সরাসরি ধরিয়ে দেন:

...আকাশের রঙিন মেঘ ও ভাসমান পাখি, ভাঙন-ধরা তীরে শুভ্র কাশ ও শ্যামল তরু, নদীর বুকে জীবনের সঞ্চালন, এসব কিছুই যদি না থাকে, শুধু এই বিশাল একাভিমুখী জলস্রোতকে পদ্মার মাঝি ভালোবাসিবে সারাজীবন। মানবী প্রিয়ার যৌবন চলিয়া যায়, পদ্মা চিরযৌবনা। বৈচিত্র্য? কী তার প্রয়োজন? নতুন পৃথিবী কে খোঁজে, কে চায় পদ্মার রূপের পরিবর্তন, শুধু ভাসিয়া চলার অতিরিক্ত মোহ।

'নদী ছাড়া সব বাহুল্য।'—বস্তুত অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্যটিই এই উপন্যাসে অবিকল্প হয়ে থাকে।

এপিকের মতো দেশ-কাল-পরিস্থিতি-জাতি-জাতীয়তা-চিরকালীন মূল্যবোধ-ন্যায়-অন্যায়-পাপ পুণ্যের খাড়াখাড়ি বিভাজনের ইতিবৃত্ত হয়ে না উঠলেও মহৎ উপন্যাস প্রায়শই ব্যক্তিমানুষের আশ্রয়ে বিরাট একটি সিস্টেমের বা তন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে চায়। (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী' সম্পর্কে এই কথাটিই নিজের মতো করে বলতে চেয়েছেন দাশগুপ্ত: ১৩৯৭ ব.) আর তখনই সময়ের ক্ষুদ্র আয়তন অতিক্রম করে রচনাটিতে সম্প্রসারিত সময়প্রবাহের প্রাণধারা, চাঞ্চল্য সঞ্চারিত হতে থাকে।

সাধারণ অর্থে আমরা যাকে সুখ-দুঃখ, জীবন-মৃত্যুর সীমা-চিহ্নিত জীবন বলে মনে করি তাকেও এখানে অনায়াসে অতিক্রম করে যান রচক। আর হয়তো সেই ঈষৎ নিষ্ঠুর ও নির্বিকল্পতাকে সাধারণ পাঠকের মনে হতে থাকে অপরিবর্তনীয়, মানুষের চেষ্টিতের অতীত—মনে হতে থাকে প্রকৃতিধৃত এই পৃথিবীর সঙ্গে সভ্যতা ও মনীষার প্রাগিতিহাস থেকে মানুষের যত বিরোধ, যত সখ্য বা তাকে নিজের মতো করে ব্যবহারের যাবতীয় কলা ও কৌশল—সব যেন নিষ্ক্রিয়-ব্যর্থতা ও বিনাশে অবনত হতে বাধ্য।

মানিক পদ্মানদীর মাঝি-তে পদ্মার প্রবাহকে কিংবা পুতুলনাচের ইতিকথা-র সূচনায় হারু ঘোষের মৃত্যুর (হারুকে আকাশের দেবতা বর দেননি—হারুর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন পল-স্থায়ী একটি বজ্র-কটাক্ষ! আর তাতেই হারুর একান্ন বছর ধরে আত্মমমতায় গড়ে তোলা 'জগৎটি চোখের পলকে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে') ঘটনাকে কেতুপুর ও গাওদিয়ার সীমাতিক্রমী এক বৃহৎ পটে প্রতিস্থাপিত করেছেন। আপাতভাবে মানিকের রচনায় প্রকৃতির উপস্থিতি এবং তার সক্রিয়তাকে শিথিল ও বিচ্ছিন্ন স্কেচ বলে মনে হলেও প্রকৃতির সামগ্রিক প্রেক্ষিতটি উপন্যাসের অন্দরে নিস্পৃহ সময়ের দ্রষ্টা হিসেবে নিরন্তর সক্রিয় থাকে।

সর্ববিরোধ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা
-------------------------------------------------

অবিকল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 
শতঞ্জীব রাহা

প্রচ্ছদ : শোভন সরকার ও শ্রেয়ান
 
মুদ্রিত মূল্য : ৫০০টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।