বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া।। সম্পাদনা : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।।
"গঙ্গা থেকে বয়ে আসে একটা সিরসিরে বাতাস, ছোটোকাকার হাতের রেডিয়াম ঘড়ির কাঁটা একটু একটু করে সরে সরে যাচ্ছে। সেই সন্ধে থেকে বড্ড তাড়াহুড়োর কেটেছে সময়টা। ডাক্তার, সার্টিফিকেট, খাট, ফুল, অগুরু, ধূপের ব্যবস্থা মিটতেই পারিবারিক প্রথা মেনে রাতেই দেহ নিয়ে আসা হয়েছে নিমতলা। কিশোরটি একবার শ্মশানযাত্রী হওয়ার কথা বলতেই কেউ খুব একটা আপত্তি করলো না। আর তাই তার শ্মশানের রাত দেখার প্রথম সুযোগটাও হয়ে গেল।
কাঠের চুল্লিতে দাহ হচ্ছেন পিতামহী। এক জীবন ভরা শোক-তাপ-রোগ-ব্যাধির সঞ্চয় নিয়ে পাকা ফলের মতো বোঁটা থেকে খসে পড়া মানুষের জন্য উথালপাথাল শোকের তরঙ্গ ওঠে না। নিমতলা শ্মশান ঘাটের বাঁধানো ধাপগুলোর উপর ভাটার হালকা ঢেউয়ের মতো এক-দুটো টুকরো স্মৃতি ভাঙে। সঙ্গে থাকা আত্মীয় প্রতিবেশীদের কথায় তেমনি ছোটো ছোটো ঢেউ গুনতে গুনতে চোখ লেগে আসে। কিছুটা ক্লান্তিতে, বাকিটা খিদেয়।
—চল কিছু খেয়ে আসি। এখনো বেশ কিছুক্ষণ লাগবে।
-ভোর হওয়ার আগে তো বাড়ি ঢোকাও যাবে না।
—হ্যাঁ, তেমনি নিয়ম, আলো ফোটার পর নিম, আগুন, লোহা ছুঁয়ে বাড়ি ঢুকতে পারবে সবাই।
টুকরো টুকরো কথা কানে আসে। রেডিয়াম ঘড়ি জানান দেয়— রাত দুটো, তারিখ বদলে গেছে।
ঘাট থেকে উঠে কুকুর আর মানুষের কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা ঘুমন্ত শরীর পেরিয়ে হাঁটতে থাকে তারা। পেরিয়ে আসে ধোঁয়ার ঘেরাটোপে ঢাকা দলবদ্ধ মানুষের অবাস্তব অবয়ব। একটু হেঁটেই বড়ো রাস্তা। পর পর কয়েকটা খাবারের দোকান। এত রাতেও আলো জ্বলছে। উনুনের আঁচ রাস্তার টিমটিমে আলোয় আরও তীব্র মনে হয়। শোক, ক্লান্তি ছাপিয়ে জেগে ওঠে খিদে। প্লেটে পড়তে থাকে গরম লুচি আর আলুর তরকারি। শেষে আসে রসগোল্লা।
নিমতলা শ্মশানের একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। আসল কলকাতা আর তার আসল মানুষগুলোকে চেনার এমন ক্লাসরুম খুব কম আছে। মাঝরাত পার করে ডেরায় ফেরা একটি মানুষ নিজের খাবারের ভাগ চেয়ে তীব্র চিৎকারে ভেঙেছে রাতের নিস্তব্ধতা। রাত শেষে অস্থি তুলে দেওয়ার জন্য ডোমের সঙ্গে দরকষাকষির সাক্ষীও থাকল সে। আরও টুকরো টুকরো ঘটনা আর অনুভূতি পেরিয়ে ভোর হতে যখন সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল, তখন হঠাৎ করেই যেন বড়ো হয়ে গেল ছেলেটি। আর সেই বড়ো হয়ে ওঠার পথের বাঁকে চিরদিনের মতো ছাপ রেখে গেল মাঝরাতের লুচি তরকারি আর মিষ্টির স্বাদ।
মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা অনেকের ক্ষেত্রে ‘বড়ো' হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় একটা অনুঘটকের কাজ করে। বড়ো হয়ে যাওয়ার মানসিক প্রক্রিয়াকে সেভাবে প্রভাবিত না করলেও, খাবারের স্মৃতি আমাদের বড়ো হয়ে ওঠার যাত্রাপথে অজান্তেই ছাপ ফেলে যায়। খাবার, বিশেষ করে পছন্দের খাবারের স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ বাল্য-কৈশোর পেরিয়ে যৌবন প্রৌঢ়ত্বের গলি ঘুরে বার্ধক্য পর্যন্ত নিঃশব্দে আমাদের পাশাপাশি হেঁটে যায়।
গত শতকের ছয়-সাতের দশকের বাগবাজার-শোভাবাজার এলাকায় খাবারের এত বৈচিত্র্য ছিল না। কিন্তু তার মধ্যে দিয়েই যেন একটি কিশোরের বড়ো হয়ে ওঠার গল্পটা বোঝা যায়। সেই স্বাদ আর গন্ধগুলি ফিরে দেখলে একটা হারিয়ে যাওয়া সময়ের কলকাতা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভোরের কুয়াশা আরও গাঢ় করা কয়লার উনুনের ধোঁয়া, হাতিবাগান পাড়ার সাদা-কালো সিনেমা, লাল দোতলা বাস, পথসভা, মিছিল — সব নিয়ে ভেসে ওঠে স্মৃতির শহর।
এক কাল্পনিক টাইম মেশিনে চড়ে এমন এক গ্রীষ্মের দুপুরে গত শতকের ছয়ের দশকের বাগবাজারে ফিরে গেলে দেখব যে মায়েরা শিশুদের খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়াতেন। ঠিক সাড়ে তিনটে নাগাদ গলিতে শোনা যেত কাঁসর পেটানোর শব্দ আর সঙ্গে বাসনওয়ালর ডাক— ‘চাই বাসুউউ...ন'। এটা ছিল শিশুটির বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়ার সফট সিগন্যাল। মানে এখন উঠলে মা আর বারণ করবেন না। এরপর, চারটে নাগাদ আসতেন একজন চিনেবাদামওয়ালা। তার অনন্যতা ছিল বাদামের সঙ্গে দেওয়া নুনের মধ্যে। সাধারণত বাদামের সঙ্গে শুকনো নুন দেওয়া হয় দেখেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এই বাদামওয়ালা দিতেন ভিজে নুন। নুনের সঙ্গে মেশানো থাকত লঙ্কা, ধনেপাতা। তারপরেই আসতেন বিস্কটওয়ালা—একটি মলিন বিবর্ণ টিনের বাক্সে সুজি বিস্কুট, নিমকি বিস্কুট, ঝাল বিস্কুট—এমন রকমারি বিস্কুট নিয়ে। শিশুদের ঝাল খাওয়ার হাতেখড়ি হতো এমন ঝাল বিস্কুট অথবা স্কুলের বাইরে বিক্রি হওয়া ঝাল কচুভাজার হাত ধরেই। সাধারণত বড়োদের কাছে আবদার বা বায়না করে হাতে পাওয়া যেত এই সব মহার্ঘ সামগ্রী।......"
শালপাতায় স্মৃতিমাখা আলুর দম : উত্তর-কলকাতার পথঘাটের খাবার
---------------
অমিতাভ পুরকায়স্থ
বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া
সম্পাদনা : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
প্রচ্ছদ : শোভন সরকার
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত, শোভন সরকার, মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা
#সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment