নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ।।
বাজারের সবচেয়ে জমজমাট এলাকা। গোল করে ঘিরে রয়েছে সাদা চামড়ার মানুষ। মাঝের উঁচু পাটাতনে একে একে তোলা হচ্ছে বন্দি দাসেদের। কালো লোহার শেকল ছাড়া কারোর গায়ে একটা সুতো নেই। পাশাপাশি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা তাদের দু'হাতে অসহায় যৌবনকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। একটু পাশে বেত হাতে দাঁড়িয়ে আছে যে, তার গায়ের রং-ও কালো, অথচ কী চমৎকার নির্বিকারে সে আঘাত করছে স্পর্ধিত হাতে! সঙ্গে অকাতরে বিলিয়ে চলছে অশ্রাব্য ভাষা। ক্রেতা যারা, সবটা দেখেশুনে তবেই না উপযুক্ত দর দেবে। ঘিরে থাকা মুখগুলো যেন মানুষের নয়, বুনো কুকুরের। রক্তের নোনতা স্বাদ পাওয়া কোনো নরখাদক। দৃশ্যগুলো কল্পনা করে মাগাতার চোখদুটো জ্বলে উঠল। হা ঈশ্বর! আফ্রেয়া, কোনো এক সুখের মুহূর্তে যার জন্ম, যার কাছে নিজের সমস্ত জীবন সমর্পণ করেছিল মাগাভা, রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার এমন দুর্দশা! কত গ্লানিই না সহ্য করতে হয়েছে মেয়েটাকে। আরও কত করতে হবে। এর চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। একদিন ভোলটা নদীর পাশে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল দু'জনায়, এখন তাদের ভবিষ্যত সমুদ্রের মতো অনিশ্চিত। শেষের কয়েকদিন ধরে ভুডু আগবে-এর কাছে অহোরাত্র প্রার্থনা করছে মাগাভা—ওঠো হে সমুদ্র দেবতা। ফুঁসে ওঠো। তোমার উন্মত্ত ক্রোধে ধুয়ে দাও সমস্ত অনাচার। অকুণ্ঠিত দক্ষতায় শীতল সহজ মৃত্যু নামাও এই দাস বন্দরে। কিন্তু না, ভুডু আগবে তার প্রার্থনা শোনেনি। আর মাত্র কয়েক প্রহর। তারপর বন্দরে ভাসতে থাকা ওই বিরাটকায় কাঠের খাঁচা হবে তাদের একমাত্র ঠিকানা।
কানের ফাঁকে, চুলের সঙ্গে গুঁজে রাখা রক্তলাল ইয়োরোবা ফুল। মুখের কুয়াশামাখা হাসিতে রহস্যময় আহ্বান। এই মুহুর্তে বন্ধ চোখে নিজের প্রিয়তমাকে এভাবেই যেন দেখতে পাচ্ছে মাগাভা। দেখতে দেখতে থিরথির করে কাঁপছে তার পুরু চ্যাটাল দন্তচ্ছদ।
'নিজের কথা ভাব মাগাভা।'
পাশ থেকে ঘষঘষে স্বরে গায়েরা বলল, 'সকাল হলে সকলকে জাহাজে নিয়ে গিয়ে তুলবে। এখানেই যা অবস্থা! আমাদের গ্রামে পশুগুলোও এর চেয়ে ঢের আরামে থাকে। তার ওপরে শুনছি অনেক দূরের পথ। রসদে টান পড়লে আবার মাঝসাগরে ছুঁড়ে না ফেলে দেয়।'
মাগাভাও জায়গাটার নাম শুনেছে। প্রথমবার। মেক্সিকো। তিন মাসের কাছাকাছি লাগবে পৌঁছোতে। সে ঘাড় নাড়ল। যদিও পাথুরে ঘরের আঠালো অন্ধকারে তার নড়াচড়া কারও নজরে এল না।
'তেমন হলে দিতেই পারে। এদের কাছে মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই গায়েরা। তবে তার আগে আমাদের নিয়ে আমোদে এতটুকু খামতি রাখবে না।'
জবাব দেওয়ার ফাঁকে স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটায় নজর বুলিয়ে নিল মাগাভা। চোখের পাতাকে অনেক কষ্ট করে অন্ধকার সরাতে হচ্ছে। সেই অন্ধকারে আরও ঘন কালো ছায়া শরীর ঠাসাঠাসি করে বসে। কেউ বা আধশোয়া। সারাদিনে মাঝেমধ্যেই কেঁদে-কঁকিয়ে উঠছিল অনেকে। হয়ত অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে, প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদের যন্ত্রণায়। সেই কান্নার স্বর স্তিমিত হতে হতে এখন একেবারে মরে গেছে। শরীর এবং মনেও ক্লান্তির অধিকারবোধ, আশঙ্কা কিংবা বিষাদের থেকে বেশি। মাঝে-মাঝে ঘুমন্ত মানুষগুলোর পাশ ফিরলে অথবা পাশের জনের গায়ে ঢলে পড়লে, লোহার শেকল পাথরের মেঝেতে ঘষা খেয়ে অন্তহীন নিস্তব্ধতায় বিরতি আনছে। তারপর আবার স্তব্ধতা জাঁকিয়ে বসছে।
'যাই হোক না কেন, আমাদের একসঙ্গে থাকা দরকার মাগাভা। সেরকম পরিস্থিতি হলে একটা লড়াই অন্তত দেওয়া যাবে।'
নীরবতা ভেঙে বলে উঠল গায়েরা। তার কথা শুনে স্বজন হারানো বিষাদের মধ্যেও জোরে হেসে উঠল মাগাভা।
'এখনো লড়াইয়ের কথা ভাবছিস তুই! জাহাজে তোলার আগে এরা তোর হাতে, হয়ত পায়েও বেড়ি পরিয়ে দেবে। লড়াই দিবি কীভাবে শুনি? এখন বেঁচে থাকা মানুষধরাদের অনুগ্রহের ওপরে। তাদের মর্জিতে চলতে হবে গায়েরা। ভুলে যাস না আমরা এখন ক্রীতদাস। আর দাসেদের নিজের ইছে-অনিচ্ছা বলে কিছু থাকতে নেই। মালিক যখন চাইবে, যেমন চাইবে, তেমনটাই করে যেতে হবে। যতদিন না তোর বুকের নিচে শেষ শ্বাসবায়টুকুও ফুরিয়ে যাচ্ছে, ততদিন।'
অন্ধকারে গায়েরার দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে গেল তার বন্ধুকে।
'ততদিন পর্যন্ত এই লোহার শেকল...'
'আমাদের ভবিষ্যত।'
গায়েরার অনুচ্চারিত শব্দগুলো হাহাকারের মতো বেরিয়ে এল মাগাভার বুক থেকে, 'শুধু যাওয়ার আগে একবারের জন্য হলেও যদি আফ্রেয়াকে দেখতে পেতাম... এই রুক্ষ জীবন নিয়ে আক্ষেপ থাকত না বন্ধু।'
পাথুরে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে নিষ্ঠুর রাত্রিকে ফিকে হতে দেখেছে মাগাভা। দিগন্তে সকালের প্রথম আলোর ছোঁয়া লাগা মাত্র সার বেঁধে বের করে আনা হয়েছিল তাদের। তারপর যেভাবে আনা হয়েছিল, সেভাবেই কাঠের পাটাতন বেয়ে তুলে দেওয়া হয়েছিল জাহাজে। গোটা প্রক্রিয়ার তত্বাবধানে ছিল এক ঊর্ধ্বকায় কৃষাঙ্গ। অবশ্য কেবলমাত্র গায়ের রংই এক, পোশাকে বা মেজাজে তাদের সঙ্গে আলোকবর্ষ তফাত। অকারণে চাবুক নামিয়ে আনছিল অসহায় বন্দি দাসেদের শরীরে। কালো চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসা রক্তস্রোত দেখে উল্লসিত হচ্ছিল। কয়েকটা আঘাত মাগাভার ভাগ্যেও বরাদ্দ ছিল। ছাপিয়ে যাওয়া মানসিক যন্ত্রণায় শরীরে সেই আঘাত আলাদা করে অনুভূতি জোটাতে পারেনি। মাগাভার চঞ্চল দৃষ্টি তখন বন্দরে জড়ো হওয়া অগণিত মানুষের মাঝে খুঁজে চলেছিল একটিমাত্র মুখকে। আফ্রেয়াকে। তার সেই আশা দিগন্তরেখার মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
মাগাভা জাহাজের কথা শুনেছিল। দেখেনি। অবশ্য এখনও তাদের যেখানে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে এই জাহাজকে সম্পূর্ণরূপে দেখা সম্ভব নয়। কাঠের তক্তা জুড়ে বানানো একটা কুঠুরি। সম্ভবত জাহাজের সবচেয়ে নিচের অংশে রয়েছে তারা। প্রতিবার তরঙ্গের অভিঘাতে জাহাজ দুলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলায় খোলের মধ্যে জলের 'ছলাৎ চল' শব্দ কানে আসছে। একশো জনের জন্য এই কুঠুরিটা বড্ড ছোটো। হাত-পা ছড়িয়ে বসার জায়গাটুকুও অমিল। মাঝে মাঝে শরীর ঘেঁষে এমাথা থেকে ওমাথা ছুটে যাচ্ছে ইঁদুরের দল। কোনো ভয়ডর নেই! হয়তো ওরাও জানে জাহাজের খোলে বন্দি দাসেদের সঙ্গে তাদের বিশেষ ফারাক নেই। পার্থক্য বলতে ইঁদুরগুলো স্বাধীন, আর মাগাভাদের হাত পা শেকলে বাঁধা।
গর্তের কাছে অনড় একটা ইঁদুরের দিকে তাকিয়ে একমনে ভেবে চলেছিল মাগাতা। এইভাবে তাদের সাদা চামড়াদের দেশে নিয়ে যাবে! এতগুলো দিন এই বদ্ধ কুঠুরিতে কাটিয়ে সবাই শেষমেশ ডাঙার মুখ দেখতে পারবে তো? মাগাভা জায়গাটার নাম শুনেছে। মেক্সিকো। মধ্য-আমেরিকার একটা অঞ্চল। সুসভ্য সাদা চামড়াদের রাজত্ব। সেখানে চাষের কাজে লাগানো হবে তাদের। সাদা চামড়ার মানুষগুলো কি কৃষিকাজ জানে না? নাকি চাষ করা সভ্য মানুষের কাজ নয়? তাই ফসল ফলানোর মতো পবিত্র কাজের পুরোহিত হিসেবে দূর দেশ থেকে নিগার কিনে নিয়ে যেতে হয়!
নিগার। কালো চামড়াদের এই অদ্ভুত নামে ডাকা হয় দাস বন্দরে। জাহাজেও। এখানে কেউ গায়েরা কিংবা মাগাভা নয়। সকলের একটাই নাম। নিগার। মাগাভা মুখের ভাঙা দাঁতে আটকে থাকা শুকনো রুটির টুকরো 'থুঃ' করে ফেলল। তখনই মাথার ওপরে কুঠুরির ছোটো দরজাটা শব্দ করে খুলে গেল।
নষ্ট চাঁদের আলো
অলোক সান্যাল
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী, অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
ছবিঋণ : আন্তর্জাল
Comments
Post a Comment