শারদ নির্মুখোশ ১৪৩১।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
শারদ নির্মুখোশ ১৪৩১ পড়ে আলোচনা করেছেন শুভ রায়চৌধুরী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.................................................
শারদ নির্মুখোশ ১৪৩১ পড়া শুরু করেছি। প্রথম ছ'টি ছোটগল্পের পাঁচটি এবং দুটি উপন্যাস পড়লাম। ভেবেছিলাম সব গল্পগুলো আর উপন্যাসিকার অন্তত একটা পড়ে নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাব। কিন্তু সে আর হল না।
কারণ, শুভজিৎ ভাদুড়ী'র উপন্যাস 'লেলানু'।
কোনও লেখক বা লেখাকে মহৎ/ভালো বা জঘন্য/মন্দ বলার অধিকার আমাকে কেউ দেয়নি। আর সেটা বলাও যায় না। কিন্তু এই উপন্যাসটির পাঠ-অভিজ্ঞতা ভাগ করে না নিলে, নিজের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি হবে। তাই, দু'-চার কথা লিখলাম।
উপন্যাসটি অনেকটা পিকারেস্ক ধারার (আপনি অস্বীকার করতে পারেন)। প্রথমেই এই কথাটা বললাম, কারণ লেখক একটা সময়ের কথা তুলে আনতে একটি নির্দিষ্ট চরিত্রকে নায়ক করে তুলেছেন, এবং তার চারপাশের পঙ্কিল সমাজ-রাজনীতিকে জুড়েছেন। কোন সময়ের কথা লেখক এনেছেন? মোটামুটি গত দুই দশকের সময়কাল, যেখানে বাম রাজনীতির অবসান ঘটে তৃণমূল দল শাসনে আসছে এবং ধীরে ধীরে তাদের ক্ষমতা ও দুর্নীতি জনমানসে প্রভাব ফেলছে। এর পাশাপাশি 'হিন্দু পার্টি' ক্রমশ শিকর বিস্তার করছে। অর্থাৎ সমসাময়িক ইতিহাস উপন্যাসে উঠে এসেছে। আমার ব্যক্তিগত মতামত, যেকোনও লেখকের লেখক-জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজের সময়টাকে নথিবদ্ধ করে রাখা (ইতিহাস ও পুরাণের দিকেও আমাদের ফিরে তাকাতে হয়, কিন্তু সেক্ষেত্রে দেখেছি, চিন্তার পঙ্গুত্ব ও অন্তঃসারশূন্যতায় সুলিখিত অনেক উপন্যাসই 'ওয়ান-টাইম রিড'-এর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না)। যা-ই হোক, এ যদি হয় উপন্যাসের সময়কাল, তবে পরিসর হিসেবে আমরা পাই মালদা জেলার কোনও একটি গ্রামকে। উল্লেখ্য, গ্রাম বলতে কতগুলো গ্রামীণ চিত্রপট, কিছু গ্রামীণ ভাষা কিন্তু নয়। খেয়াল করেছি, বেশিরভাগ লেখাতেই গ্রামের মানুষরা একইরকম ভাষায় কথা বলেন। ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের একেক জেলার মানুষের একেক রকম বাচনভঙ্গি। আবার একই জেলার দুই প্রান্তের মধ্যেও ভাষার তারতম্য থাকে। প্রমিত ভাষার হেজেমনিক আচরণের কারণে ভাষার আঞ্চলিক রূপগুলো একটু-একটু করে চলতি লেখালিখি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই, ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও লেখককে অনেক সময় সচেতন হতে হয়। এই উপন্যাসেও লেখক ভাষার সেই আঞ্চলিক রূপ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তাই বাংলার যেকোনও একটি গ্রাম নয়, বরং মালদা জেলার একটি গ্রামকেই আমরা উপন্যাসে পাই।
এবার বলি চরিত্রদের কথা। আগেই বলেছি মূল চরিত্র লেলানু। তাকে ছোট থেকে সবাই বোকা ছেলে হিসেবে জানে। বাপ তাকে মারে। বাপের স্নেহ না পেলেও মা মিনতির স্নেহ তার জন্য সবসময়ই ছিল। বাপের সঙ্গে তার বরাবরই মানসিক দূরত্ব। হয়তো সে-কারণেই লেলানু বার বার ছুটে গিয়েছে 'ফাদার ফিগার'-এর সন্ধানে। এই 'ফাদার ফিগার' কখনও নেহেরুল চাচা, কখনও ধনুক জ্যাঠা, বা কখনও ফিরোজ। এরা প্রত্যেকেই অর্থ-ক্ষমতা বা রাজনৈতিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। আর লেলানু, হয়তো বোকা বলেই, সেই দুর্নীতির অংশ হয়ে উঠেছে। সে বোকা থেকে চালাক হয়ে উঠছে যত, ততই দুর্নীতির লতাপাতা তাকে জড়িয়ে ধরছে। লোভ তাকেও গ্রাস করছে। সেও চাইছে রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশ হয়ে উঠতে।
আর, গ্রামীণ অর্থনীতির কথা লেখক কীভাবে তুলে আনছেন? কয়েকটি উদাহরণ দিই (বানান অপরিবর্তিত)—
লেলানু আর তার বউদির কথোপকথন:
"'বিয়ের আগে তুমি জানতা বিড়ি বাঁধতে?'
আদরী হেসে কুটিপাটি খায়, 'হামাদের অহানে একটা চালু কথা আছে কী, মেয়ে বিড়ি বাঁধতে না জানলে বিয়েই লাগবে না।'"
অথবা,
"...লেখা থেকে মুখ উঠিয়ে হঠাৎ চরণ বলল, 'গাঁও কা তিন নখরি মাটটি বিড়ি বখরি।'"
অথবা,
"ম্যাডাম বলছে, কী হল বল? কী তোর স্বপ্ন? কোথায় লেবার খাটবি দিল্লীতে বোম্বেতে না গুজরাটে? ঘর শুদ্ধ সবাই হাসছে হ্যা হ্যা করে। ম্যাডাম হাসছে হ্যা হ্যা করে।"
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন ঘুষ দিয়ে শিক্ষকতার চাকরির প্রসঙ্গ এসেছে, আবার টাকা দিয়ে 'সেটিং' করে কীভাবে বুথ দখল করতে হয়, বাইরে থেকে গুন্ডা এনে কীভাবে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়, তার কথাও আছে। আবার অন্য দিকে প্রশাসনিক স্তরে ঘুষ দিয়ে কীভাবে কাজ হয় সেটাও উপন্যাসে পেয়েছি, ডিটেইল-এ। শুধু তাই নয়, নেতাদের দলবদলের রাজনীতি নিয়ে যে মানুষ সরব, সে-কথাও আছে (বানান অপরিবর্তিত)—
"'না না মানুষ ওকে দেখে লিবে।' কেউ কেউ গলা মিলায়।
...
বাচ্চাকাচ্চারা আবিষ্কার করেছে (...) কানের কাছে গিয়ে 'মানুষ' বললেই পাগলাচরণ হা হা হা করে হাসে। কখনও হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।"
আসলে, লেলানুর মাধ্যমে লেখক আমাদের এই শতাব্দীর দেড়-দুই দশকের কালেকটিভ মেমোরি'কে জাগিয়ে তুলেছেন। কী সীমাহীন দুর্নীতি আর পচনশীল সমাজব্যবস্থা আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরেছে, এ-উপন্যাস তারই সাক্ষ্য বহন করে।
উপন্যাসটির গল্পের বিস্তারিত আমি আলোচনা করব না। তবে মিনতি, আদরী, রামসুরত, মিত্তন, জগন্নাথ মণ্ডল, সুহাগী ইত্যাদি বহু চরিত্র গল্পে এসেছে। চরিত্রগুলো শুধু লেলানুকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য নয়, তাদের আলাদা আলাদা গল্প আছে এবং সেটাও উপন্যাসের মূল বক্তব্যের থেকে ভিন্ন নয়। বয়ানের ক্ষেত্রে, লেলানুর জীবনের একটা রাতের ঘটনা এবং সেখান থেকে বার বার আমাদের ফিরে যেতে হয় অতীতে ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে। সুতরাং গল্প রৈখিক নয়। একটু ধৈর্য ধরতে হয়। আর যেটা আমার ভালো লেগেছে, উপন্যাসটিকে 'সিনেম্যাটিক' (বা ওয়েব সিরিজ/ চিত্রনাট্যের মতো) করে তোলা হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সিনেমা আর সাহিত্য কখনই এক নয়, সাহিত্য সিনেমার মতো হয়ে উঠলে (তা সে যত ঝকঝকে লেখাই হোক না কেন) সাহিত্যগুণ হারায়।
***
অন্য যে উপন্যাসটি পড়েছি, সেটা হল সমরেন্দ্র মণ্ডলের 'জন বিলাসের বারোমাস্যা'। এই উপন্যাসটির বয়ান মোটামুটি রৈখিক। প্রধান চরিত্র জন বিলাস সরকার। 'জন বিলাস', এই নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে চরিত্রটির মানসিক এবং আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব। সে কি জন নাকি বিলাস? বার বার তার দুই সত্ত্বা মুখোমুখি হয় আর সেটার সাক্ষী থাকেন সর্বজ্ঞ লেখক। এছাড়াও রয়েছে তার রাজনৈতিক মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব। কারণ চরিত্রটি নিজে গত শতাব্দীর একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে— তখনও বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতায় কংগ্রেস; লাল পার্টির উত্থান হচ্ছে। পাশাপাশি নকশাল আন্দোলন। তারপর সত্তরের শেষ দিকে পালাবদল। তার আগে ইমার্জেন্সি। ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে রাজনীতির অলিন্দে ক্রমশ ঢুকে পড়েছে জন। আর অন্য দিকে একটু-একটু করে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে বিলাস। বিলাস কবি, বিলাস হল জন-এর শৈশব লালিত ভিন্ন এক মানুষ। বিলাস নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, কিন্তু প্রতিবারই সামনে চলে আসে জন। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে চরিত্রটি ভেসে চলেছে শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে আর-একটা গ্রামে। 'দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ'-এর কথা মনে পড়ছিল, যদিও সেটা আমার অতি চিন্তা হতে পারে।
তবে, চরিত্রটির পাশাপাশি ঘুরতে ঘুরতে আমরা মুখোমুখি হই ওই দশকগুলোর সঙ্গে। সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট লেখক পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। এক জায়গায় লেখক লিখেছেন (বানান অপরিবর্তিত),
"সময়ের হিসাব তার কাছে হারিয়ে যায়। পাহাড়ের শরীরে পা রাখতে গিয়ে দেখে রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ঠুর অত্যাচার। তাই মনে হল বিলাসের। পাহাড়ের গায়ে ভোটের পোস্টার। তার ভিতর কবিতা গুমড়ে উঠল। সেদিনই সে লিখেছিল,
পাহাড়ের বুকে এঁকে রেখেছো নির্বাচনী প্রতীক
তুমি তো শোননি তার কান্না,
পাথরের খাঁজে খাঁজে খিদের চিৎকার
ছিঁড়ে ফেলেছে জননীর শরীর
আদুল শরীরে শুকনো স্তনে গুঁজে দিচ্ছে শিশুর মুখ
ওখানে শুধু হাহাকার ছোটাছুটি করে।"
***
প্রথম ছ'টি ছোটগল্পের মধ্যে অনিল ঘোষের 'অরূপনগরের কিসসা' এবং অবিন সেনের 'বিষাদবেলা' আমার মনে থাকবে। 'অরূপনগরের কিসসা' আমাদেরকে দেখায় কোনও একটা মর্মান্তিক ঘটনার অভিঘাত আমাদের যতটা না জর্জরিত করে, তার চেয়েও বেশি আমরা গালগপ্পো-আলোচনার রসদ পাই। এ তো আজকের দিনে দাঁড়িয়েও দেখছি। দুটো গল্পের ক্ষেত্রেই জাতপাত, ধর্ম, কাঁটাতার ইত্যাদি ছাড়িয়ে মানুষ এবং তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের কথা উঠে আসে। প্রথমটার ক্ষেত্রে যদি হয় 'কিসসা', তবে দ্বিতীয় গল্প 'বিষাদবেলা'য় আছে 'ভালোবাসা'। মিতে বউ-চাঁদবিবি বা অহনা-বিভূ ইত্যাদি চরিত্রগুলো সহজে ভোলা যাবে না।
নির্মুখোশ শারদ ১৪৩১
অলংকরণ: অদ্বয় দত্ত
সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য ৩০০/-
Comments
Post a Comment