অভিমানভূম।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।।

পুরুলিয়া স্টেশনের আগে আদ্রায় বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়ায় ট্রেনটা। আদ্রা থেকে তারপর ট্রেনের একটা ভাগ চলে যাবে বোকারো; অন্য ভাগটা পাড়ি দেবে পুরুলিয়ার দিকে। ঘুম যখন ভাঙল, আদ্রা পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে। এতদিন পর যাতায়াতে নতুন লাগছে যেন সব কিছুই। অচেনা নামের স্টেশন। বদলে যাওয়া মানুষের চেহারা। এবং ভয়ঙ্কর রকম ঠাণ্ডা একটা। বাইরে জমাটবাঁধা কুয়াশা। কুয়াশার আবরণ একটু হালকা যেখানে, সেখানে দূরে কোথাও চোখে পড়ছে ঝাপসা পাহাড় বা টিলা। পাঁচ টাকা এগিয়ে দিয়ে গরম চায়ের ভাঁড় চেপে ধরি হাতে। হঠাৎ সহযাত্রীদের মধ্যে একটা উশখুশ ভাব লক্ষ করা যায়। জিজ্ঞেস করি, 'দাদা, পুরুলিয়া স্টেশনটা?' —এই তো আসছে। আপনিও নামবেন নাকি?

ট্রেন থেকে নেমেই কেঁপে গেলাম আরো। এটা কেমন ঠাণ্ডা! জ্যাকেটের ভিতরে হাফহাতা সোয়েটার। তাও যেন তীরের মতো বিধছে হাওয়া।
যেখানে পৌঁছোতে হবে সেটা আরো প্রায় পঞ্চাশ বা পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরে। এখানেই এমন ঠান্ডা হলে সেখানে যে কী অবস্থা হবে, সেটা ভাবতে ভাবতেই একটা রিক্সা ধরে পৌঁছে গেলাম পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ড। হাতে কোনো সাড় নেই। আঙুলগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আবার গরম চায়ের গ্লাস চেপে ধরি দুই হাতের মধ্যে। মানুষজনের ভাষাটা বাংলা বলে মনে হলেও অদ্ভুত একটা টান। চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করি, 'মানবাজার- পুঞ্চার বাস?' আঙুল তুলে দিকনির্দেশ হয়ে যায়। সেই দিক বরাবর হেঁটে কনডাক্টরকে এগিয়ে দিই টিকিটের ভাড়া, ‘পুঞ্চা নামবো। লৌলাড়া কলেজ। জানালা দেখে দিও।' বরাবর উইন্ডো সিটের লোভ আমার। জানালা দেখেই দেয়। শহর পেরোতেই বিজাতীয় বাসের হর্নের শব্দে সামনের কুয়াশাও যেন থতমত খেয়ে যায় একটু।

জানুয়ারির সকাল। সবুজ জমির উপর থিকথিকে কুয়াশার মেঘ। সারারাতের জার্নির পরে আলস্য অথবা ক্লান্তিরা চোখ টেনে ধরে কখন যেন আবার। বাসের ভিতর ভিড়ও বেড়ে চলেছে সমানে। এইসব সহযাত্রীরাও আমার দেশের মানুষ! ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। ভাবি, বেরিয়ে না পড়লে জানা বা বোঝার গণ্ডি সত্যিই কতটা ছোটো হয়ে আসে আমাদের কাছে। এসব ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনার তাল কাটে আচমকা কন্ডাক্টরের চিৎকারে, ‘কলেজ কলেজ! কলেজ নামবেন বলেছিলেন না?'

প্রায় দু'ঘণ্টা চলল বাসটা। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ টেনে নামাই উপরের তাক থেকে। ভিড় ঠেলেঠুলে পাদানি থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নামতেই, গায়ে একরাশ ধুলো ছুঁড়ে দিয়ে চলে যায় বাস। এবার কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পারছি না। বলা হয়েছিল বাস থেকে নেমে স্থানীয় একজনকে ফোন করতে। মানুষটার নাম অঞ্জন মুখার্জি। যে সংস্থায় কাজ করি, সেখানকারই পুরোনো কর্মী এবং ‘জঙ্গলনামা' পত্রিকার বেশ কিছুটা কাজ পুরুলিয়া থেকে দেখাশোনা করেন তিনিও।

লম্বা-চওড়া চেহারার অঞ্জনদার দেখা পেতে দেরি হয় না। বলে, একটু পিছন দিকে যেতে হবে। বাইকে উঠে বসতেই নামিয়ে দেয় এক কিলোমিটারের মতো পিছনে গিয়ে একটা আশ্রমের মতো জায়গার সামনে। সংস্থার আদি অফিস এইটাই। যিনি সেক্রেটারি স্যার, তাঁর বাড়িও এই অফিসের পাশেই। প্রণাম করি বয়স্ক মানুষটাকে। যে কলেজের সামনে নামানো হয়েছিল, সেই কলেজেরই অধ্যক্ষ ছিলেন একটা লম্বা সময় ধরে। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত হলেও উৎসাহ বা উদ্দীপনায় ভাটা নেই একটুও।

‘শুভমস্তু!” মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করার পর গমগমে গলা ভেসে আসে তাঁর, ‘ঘরদোর সব বুঝে নাও। তুমি আসবে শুনে আমি পরিষ্কার করিয়েই রেখেছি আগে থেকে।' ডাক পাড়লেন, ‘গুণা, গুণা!” বেঁটেখাটো, কালো শরীর নিয়ে যে এবার মানুষটা এগিয়ে আসেন, তাঁর নাম গুণধর। চলতি নাম, গুণা। গুণাদাই দেখভালো করেন ওই আশ্রম সংলগ্ন ঘরটার। ভারী ট্রলি ব্যাগটা উঠিয়ে নিতে গেলে বাধা দিই। শুধু ঘরটা খুলে দিতে বলি।

একদম প্রান্তিক এলাকাতে হলেও ঘরের মধ্যে তিনটে সুবিধা আছে। প্রথমত, পশ্চিমী কায়দার বাথরুম।। দ্বিতীয়ত, ঘরে একটা টিভির ব্যবস্থা আছে। এবং তৃতীয়টাই হয়ত সব থেকে জরুরি, পাম্প চালিয়ে জল তোলার সুবিধা আছে। দুটো একজনের শোয়ার মতো বিছানা পাতা ঘরের মধ্যে। দুটো বিছানায় দুটো মোটা কম্বল। আর একটা করে চেয়ার টেবিল। আর কী দরকার! এই তো বেশ! নতুন সংসার হেঁটে-চলে দেখে নিলাম একবার। অঞ্জনদা এল খানিকক্ষণ পরে। জিজ্ঞেস করলাম, 'অফিসটা কোনদিকে?' ঘরের আনাচ-
কানাচ দেখতে দেখতে অঞ্জনদার উত্তর আসে, 'সেক্রেটারি স্যার বসেন এখানেই। পাশেই অফিস। তবে তোমাকে কাজ করতে হবে ওই কলেজের ওখানে। রেডিয়ো স্টেশনে।'

রেডিয়ো স্টেশন মানে কমিউনিটি রেডিয়ো। নিত্যানন্দ জনবাণী কমিউনিটি রেডিয়ো স্টেশন ভারতে যে দুশোটার মতো কমিউনিটি রেডিয়ো তখনও ছিল, তাদের অন্যতম। এবং সম্ভবত, প্রান্তিক এলাকায় এই বাংলার তখনও অবধি একমাত্র কমিউনিটি রেডিয়ো স্টেশন। কমিউনিটি রেডিয়ো স্টেশন ঠিক কী এবং কীভাবে কাজ করে, সেই কথায় পরে আসতেই হবে। এই পরিসরে আপাতত তার সঙ্গে প্রথম মোলাকাত শুধুই।

অভি মানভূম
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ ও শিল্প নির্দেশনা : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।